রূপান্তরের গল্প ৬৩ | Rupantorer

পৌঁছে গেছি! কিন্তু নামতে পারছি না! | রূপান্তরের গল্প ৬৩

পৌঁছে গেছি! কিন্তু নামতে পারছি না! | রূপান্তরের গল্প ৬৩ | Rupantorer Golpo 63 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৬৩ : বড় নদীতে জোয়ার হয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। তখন ভোর পাঁচটা। স্রোতের বিপরীতে চলছে আমাদের ট্রলার। এক ঘন্টার রাস্তা পেরুতে সময় লাগছে দুই ঘন্টারও বেশি। বড় নদীতে উল্টো স্রোতে পড়লে পথ আর ফুরাতে চায় না। গতি নেমে আসে অর্ধেকে। তখন সময়ের সঙ্গে আর পাল্লা দেয়ার উপায় থাকে না। সূর্য ওঠার আগে পৌঁছানো জরুরি। কারণ বড় নদীতে থেকে আমরা কোন খালে ঢুকছি সেটা কেউ দেখলে মহাবিপদ হতে পারে। কিছুতেই সেটা হতে দেয়া যাবে না। এই যাত্রায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সেই ঝাইলোর খালের গোলাগুলির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া যাবে না।

সূর্য ওঠেনি। কিন্তু আলো ফুটে গেছে। পশুর নদীর উল্টো পাশটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ঘসিয়াঙ্গাড়ি খালের মুখ আবছা দেখা যাচ্ছে। সেখানে আরেকটি বয়া আছে, বাতি জ্বলছে নিভছে।

মাঝ নদীতে পর পর দুটি বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙ্গর করা। তার পাশে লাগানো লাইটারেজ জাহাজগুলো। বড় জাহাজ থেকে ছোট ছোট কার্গোতে নামানো হচ্ছে ক্লিঙ্কার। আরেকটি জাহাজ থেকে সম্ভবত কয়লা আনলোড হচ্ছিলো। মাঝ পশুরে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বড় বড় ক্রেইনগুলোর শব্দ বড় বেমানান ওই বনের ভিতর।

পেরিয়ে গেলাম জাহাজগুলো। আমাদের নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নাই তাদের। আমাদেরও ছিলো না। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা এই পশুর নদী ব্যস্ত থাকে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।

আরেকটু এগুলেই পাশাখালী। সোলাইমানের ইশারায় নড়েচড়ে বসলাম। মানে সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি মামুনের হাতে সুকানি দিয়ে গলুইয়ে চলে গেলাম। পাশে এসে দাঁড়ালো বনদস্যু সোলাইমান। ততোক্ষণে সূর্য উঁকি দিচ্ছে পূর্ব আকাশে। পুরো নদী জুড়ে শুরু হয়েছে আলোর খেলা। লাল সূর্যের প্রতিফলন পড়ছে কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত নদীতে। সোনালী আভা ছড়িয়ে গেছে চারপাশে।

পাশাখালী আসার আগেই বনের ভিতরে লোকজনের নড়াচড়া দেখলাম। ওরা কারা? সোলাইমান বললো, তাদের লোক। হাত তুলে ইশারা করলাম। পাল্টা ইশারা না করে তারা ঢুকে পড়লো বনের ভিতরে। তার মানে আমাদের চলে আসার খবরটা আগেভাগে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে তারা। পুরো রাত মাথার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে দুশ্চিন্তা ছিলো তা কাটতে শুরু করেছে। তার মানে আমাদের দেয়া তাদের অবস্থানেই আছে তারা। তার মানে সত্যি সত্যি সারেন্ডার হতে যাচ্ছে!

মুহুর্তেই ক্লান্তি উড়ে গেলো। দিনের আলো ফোটার আগে আমাদের আসার কথা। কিন্তু দেরি হয়েছে। সেকারণে ভুলও বুঝতে পারতো দস্যুরা। মনের মধ্যে তাদের কতো কিছু ঘুরছে কে জানে? সোলাইমান বললো, আর চিন্তা নাই কাকু। চলে আসছি আমরা, ওরাও আছে জায়গা মতো।

পাশাখালী খালটি বেশ ছোট। ভাটার সময় বড় নদী থেকে সেখানে ট্রলার নিয়ে ঢোকা যায় না। আগের সফরে সেটা দেখেছি, জেনেছি যে এই দুর্গমতার কারণেই দস্যুতের কাছে পাশাখালী বেশ পছন্দের জায়গা। বিশেষ করে ভাটার সময় খালের ভিতরে কেউ ট্রলার, স্পিডবোট বা গানবোট নিয়ে ঢুকতে পারবে না। সুন্দরবনের অপরাধীরা এই সুযোগটিই নিয়ে থাকে। পাশাখালী নিয়ে আগেও লিখেছি। গেলোবার দস্যুবাহিনীর সঙ্গে দেখা হলো এখানেই।

তখন জোয়ারের পানি বাড়ছে। কিন্তু খালের ভিতরে ঢুকতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। নদীর তীরে ততোক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে তিনজন দস্যু। হাতে অস্ত্র, কোমড়ে গুলির পোসেস বা ব্যাগ। হাত তুলে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো দস্যুরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top