রূপান্তরের গল্প ৬৪ | Rupantorer Golpo 64

ফরেস্ট অফিস থেকে বের হলো দস্যুনেতা | রূপান্তরের গল্প ৬৪

ফরেস্ট অফিস থেকে বের হলো দস্যুনেতা | রূপান্তরের গল্প ৬৪ | Rupantorer Golpo 64 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৬৪ : আধা ঘন্টা ধরে খালের মুখে আটকে আছি। ঢুকতে পারছি না। নামতেও পারছি না কাঁদা পানির কারণে। এদিকে ট্রলার আড়াল না করে নেমেই বা কী করবো?

ডাঙ্গায় দাঁড়ানো দু’জন সশস্ত্র জলদস্যু। একজনের হাতে দোনলা বন্দুক। আরেকজনের হাতে থ্রি নট থ্রি। সামনের জনের নাম ফজলু। পিছনে হারুন। একটু দূরে ফরেস্ট অফিসের সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন সাধারণ জেলে। অবাক চোখে তারা দেখছে আমাদের। আসলে সশস্ত্র দস্যুদের দল সুন্দরবনের মানুষদের চোখে সয়ে গেছে। বন বিভাগের লোকজনদের সঙ্গেও তাদের দেখা সাক্ষাত হয় অহরহ। দুই পক্ষকেই তারা ভয় পেতোতো, এড়িয়ে চলতো। যতোই পালিয়ে বেড়াক, এই তিন পক্ষের মধ্যে দেখা সাক্ষাত চলতেই থাকে। সুন্দরবনের একটি ফরেস্ট অফিসে দস্যুরা অবস্থান করছে, সেটাও স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু সেখানে বাইরের মানুষ অর্থাৎ আমাদের উপস্থিতির বিষয়টি অস্বাভাবিক। দস্যুরা আমাদের দেখেও সরে যায়নি দেখে সম্ভবত চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এমনিতেই আতঙ্কিত থাকতে হয় তাদের। হয়তো ভাবছে, বন বিভাগের অফিসে তাদের ডাকাত দল ধরে রেখেছে। আমরা না জানি নতুন কোনো বিপদ হয়ে আসলাম!

কী খবর সবার? কথা বলে একটু ভারমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। একই সঙ্গে বুঝতে চাইলাম দস্যুদের মনোভাব। বললাম, মাস্টার ভাই, সোহাগ ভাইরা কোথায়? বললো, ফরেস্ট অফিসের ভিতরে। তোমাদের ট্রলার কোথায়? জানালো, অফিসের পিছনের খালে। জিজ্ঞেস করলাম, অন্যরা কোথায়? পিছন থেকে হারুন বললো, বাঁকী সবাই ট্রলারে। খালে ঢোকার আগে কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ওপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছিলাম। আমি বললাম, বড় নদীতে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। কেউ দেখে ফেলতে পারে। পিছন থেকে হারুন বললো, আরেকটু পানি বাড়লেই ট্রলার ঢুকবে মামা।

ইঞ্জিন আর চালু করবো না আমরা। গলুই থেকে দড়ি ছুঁড়ে দিয়েছি। মিনিট পনেরো পর শুরু হলো টানাটানি। বন বিভাগের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জেলেদের ডাক দেয়া হলো। তারা সবাই কাঁকড়া শিকারী। সবাই মিলে হাত লাগালো দড়িতে। কোনো রকমে খালের ভিতরে ঢুকতে হবে। বাইরে থেকে কেউ দেখে ফেললে পুরো কাজ ভেস্তে যাবে! ঝাইলোর খালের মতো গোলাগুলির মতো ক্রসফায়ারে আর পড়তে চাই না।

টেনেহিঁচড়ে খালের ভিতরে ঢোকানো যাচ্ছে না ট্রলার। মুখের চরটি তখনও জেগে আছে। ওদিকে অর্ধেক জোয়ার হয়ে গেছে। প্রথম জোয়ারে নীলকমল বা দুবলার চর থেকে ছাড়লে পাশাখালীতে পৌঁছে যাওয়া কোনো ব্যাপার না। কোকিলমনির কোস্টগার্ডও চলে আসতে পারে যেকোনো মুহুর্তে!

একজন জেলে বললো খালের বাম পাশ দিয়ে ঢুকবে ট্রলার। সঙ্গে সঙ্গে বনদস্যু ফজলু গালি দিলো তাকে। বললো, জানিস যখন আগে বলিস না কেন? আমি বললাম, গালিগালাজ করেন না ফজলু ভাই! ডাকাতদের এমনিতেই ভয় পায় জেলেরা। টাকার মার তো আছেই। কখন জানি পিঠেও পড়ে কিছু! হুড়মুড় করে সবাই নেমে পড়লো কাঁদায়। ট্রলারের গলুই ধরে ঘুরিয়ে দিলো দুইজন। তারপর সবাই মিলে ঠেলে বাম পাশে সরিয়ে ঠেলা দিলো। দড়ি ধরে একজন উঠে পড়লো বাম পাশের জঙ্গলে। মিনিট দশেকের চেষ্টায় আমরা ঢুকে পড়লাম পাশাখালী খালের ভিতরে। কিন্তু ফরেস্ট অফিসের জেটি পর্যন্ত যেতে যেতে আবারও আটকা পড়লাম। অর্ধের জোয়ার না আসা পর্যন্ত আর ভিতরে যাওয়া যাবে না।

উত্তেজনা ভিতরে লুকিয়ে নিজেকে খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। অন্যদিকে মনটা বেশ খারাপ হলো ওই জেলেদের দেখে। কী কষ্ট তাদের! কতো অসম্মানের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা জীবন! ফরেস্ট কিংবা বনদস্যু, কেউই ভালো ব্যবহার করে না তাদের সাথে! গালি আর মারপিট খাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই এমন একজন জেলেও সুন্দরবনে পাবেন বলে মনে হয় না। কী আর করা! জেটিতে নেমে ওই জেলেদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম আপনাদের দিন বদলাবে। একটু ধৈর্য ধরেন। জেলেদের ওই চাহনিটা সবাই পড়তে পারে না। তাতে অসহায়ত্বের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের সবার উপর রাগ আর ক্ষোভ!

পাশাখালী খালের ভিতরে কাঠের তৈরি জেটি। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ কেটে বানানো। নামলাম যেখানে সেই পথ পুরোটা হেঁতাল গাছ দিয়ে বানানো। এবার ফরেস্ট অফিসের ভিতর থেকে বের হলো সোহাগ আকন। হাতে অস্ত্র-গুলি! পিছনে পিছনে এগিয়ে আসছেন মোস্তফা শেষ অর্থাৎ সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় জলদস্যু দলের প্রধান- মাস্টার! আবার দেখা হলো তাদের সাথে। তবে সেবারের প্রেক্ষাপট ছিলো অন্য রকম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top