ভয় আর অসম্মান! বনকর্মীরা থাকতেন জড়োসড়ো | রূপান্তরের গল্প ৭১ | Rupantorer Golpo 71 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭১ : ওসি সাহেব সম্ভবত খুব একটা অভ্যস্ত নন। নতুন এসেছেন পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের দায়িত্ব নিয়ে। তখন ডিউটিতে মোট তিনজন। বড় দস্যুদলের লোকজন এসে অফিস দখলে নেয়, বনকর্মীদের বেরিয়ে যেতে হয় তখন। সেখানে বসে শিকার করে, জেলেদের নির্যাতন করে, চাঁদাবাজি করে, বিশ্রাম নেয়। তারপর পানি-খাবার নিয়ে চলে যায়। একটি দল যায়। পরের দিন হয়তো আরেকটি দস্যুদল হাজির হয়! সবার সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে হতো। আবার কখনও কখনও দস্যুরা আছে এমন খবর পেয়ে RAB– কোস্টগার্ড এর সদস্যরা আসতো। তাঁরা দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ দিতেন বনকর্মীদের ঘাড়ে। খারাপ ব্যবহারের ঘটনাও ঘটেছে, কখনও মামলার আসামীও হতে হয়েছে ফরেস্টারদের। তাই কোনো রকমে জীবন আর চাকরিটা বাঁচিয়ে দিন পার করাটাই ছিলো ফরেস্টারদের কাজ।
অস্ত্র ছাড়া বন রক্ষার দায়িত্ব পালন কেমন করে হয়? হয় না। তবুও অফিস ফাঁকা করে রাখা যায়? এমনিতে ডাকাতদের ভয়ে মৃগামারী, ঝাপসিসহ কয়েকটি জায়গা থেকে অফিসই তুলে নিতে হয়েছে। অন্যগুলোতে একদম কাউকে না রাখলে বন বিভাগ আর থাকে কোথায়?
নিয়ম রক্ষার অংশ হিসাবে পাশাখালীতে বনকর্মীরা থাকতেন। এখানে যাঁদের পোস্টিং হতো তাঁরা সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ডাকতে দিন পার করতেন। ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধ হয়? আর থাকলোই বা অস্ত্র! ওই গহীন বনে ৫০/৬০ জনের সশস্ত্র দস্যুদলকে সে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব?
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে আধা ঘন্টা ধরে। কমার কোনো লক্ষণ নাই। দস্যুদের সাথে কথাবার্তা বলছিলাম ফরেস্ট অফিসের ভিতরে বসে। ওদিকে বাইরে বারান্দার টুলে বসে ভিজছেন ফরেস্টাররা। ওসি সাহেবকে ভিতরে ডেকে নিলাম। কিছুতেই সেখানে বসতে চাইছেন না। তবুও বললাম, বাঁকী দুজনকে নিয়ে আসেন। জোর করে তাঁদের নিয়ে ভিতরে বসালাম। খুব অস্বস্তির বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা এটাই ছিলো।
ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, চোর-ডাকাত, মাছ চোর, গাছ চোর, শিকারীদের ধরার কাজ আপনাদের। আর এই অঞ্চলে বিষ দেয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্ম চলে সারা বছর। কী ভাবে সামলান? ওসি সাহেব বললেন, জীবনটা নিয়ে দিন পার করাই মুশকিল এখানে! বাঁকী কাজ করবো কী করে? যদি ডাকাতরা সারেন্ডার করে তাহলে অন্য অপরাধগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে বন বিভাগ- বললেন পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
ওসি সাহেবের ঘরের ভিতরে চারজন সশস্ত্র দস্যু বসা। পাশে বসা ফরেস্টের কর্মকর্তা। অসহায়ত্বের এমন দৃশ্য বাংলাদেশের কোথাও ছিলো বলে মনে হয় না। মাস্টারকে বললাম, দুপুর হয়ে যাচ্ছে। গোছগাছ সেরে নিতে হবে। সোহাগকে বললাম, আপনাদের বাঁকী অস্ত্রগুলো কোথায়? আমতা আমতা করছিলো সোহাগ। কিন্তু কোথাও কোনো গ্যাপ রাখা যাবে না। আমি বললাম, আগেই বলেছি- একটি অস্ত্রও জঙ্গলে থাকবে না। একটা গুলির খোসাও রাখা যাবে না। শক্ত করে বললাম, যদি কিছু জঙ্গলে রেখে যাওয়ার চিন্তা করেন তবে আমি চলে যাবো! হুমকি দিলাম জোরেসোরে!
মাস্টার বাহিনীতে অন্তত ৫০টি বন্দুক আছে। কিন্তু সামনে আছে ২২টি। বাঁকী অস্ত্রগুলো আমার লাগবেই লাগবে। দস্যুদের বললাম, দেখেন ভাই এটা বিশ্বাসের খেলা। মাঝে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। RAB জানে আপনাদের কী কী আছে! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে আমাকে লজ্জায় ফেলেন না!
(পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ঘরে দস্যুনেতা মাস্টারের সঙ্গে। ২৭ মে ২০১৬)