ভয় আর অবিশ্বাসে ঠাসা ছিলো সুন্দরবন | রূপান্তরের গল্প ৭৪ | Rupantorer Golpo 74 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭৪ : বন বিভাগের অফিসগুলো এতো মলিন কেন? বরং এই অবকাঠামোগুলো অনেক বেশি মজবুত হওয়া উচিৎ। বন কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র এতো অবহেলা করছে কেন বুঝতে পারছিলাম না। দেশে এতো বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুন হলো, তাদের থাকার জন্য বহুতল আধুনিক ভবন তৈরি হচ্ছে দেশজুড়ে! অথচ বন টহল ফাঁড়ীগুলোর দিকে তাকানো যেতো না। বসবাস অযোগ্য অফিসগুলোতে থাকতেন বনরক্ষীরা। ডাকাতদের ভয়ে অস্ত্র দেয়া হয় না।
সাধারণ গাছ চোর বা হরিণ শিকারীদের পিছনে দৌড়ানোর মতো ট্রলার নাই, থাকলেও জ্বালানী তেলের বরাদ্দ নাই। বর্ষায় ছাদ দিয়ে পানি পড়ে, জানালাগুলো কোনো রকমে দড়ি দিয়ে বাঁধা। কাঠের দরজার ছিটকিনি লাগে না। খাবার পানির বরাদ্দ নাই। ফোনের নেটওয়ার্ক নাই, তখন ওয়্যারলেস সিস্টেমও ছিলো নষ্ট! ডাকাতের তাড়া খেয়ে বনরক্ষীদের কাছে গেলে তারা আশ্রয়ও দিতে পারতেন না। বরং সেই জেলেদের তাড়িয়ে দিতেন নিজেরাও বিপদে পড়বেন বলে।
শক্ত জেটি পাইনি বেশির ভাগ ক্যাম্প-এ। পাশাখালীর জেটিটিও ছিলো নড়বড়ে, সুন্দরবনের গাছ কেটে বানানো। বর্ষায় হাঁটার পথ আর চলার মতো থাকে না। তাই হেঁতাল গাছ একটার পর একটা কেটে বিছিয়ে দেয়া। রাস্তা বলতে জেটি থেকে ফরেস্ট অফিস, সেখান থেকে পুকুর পাড়। এটুকুর মধ্যে মনে হয় হাজার দুই হেঁতাল গাছ চলে গেছে। বুঝলাম না যে ইঁট কনক্রিট নিয়ে সামান্য ওই পথটুকু বানানো যেতো না? আসলে পাশাখালীর মতো বন টহল ফাঁড়ীর দিকে বড় স্যারদের নজর ছিলো না। মংলা থেকে ৪/৫ ঘন্টা দূরত্বের এমন ফরেস্ট অফিসগুলো ছিলো অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য।
পিচ্ছিল পথ ধরে হাঁটছি। অফিস কক্ষের ভিতরের আলোচনা শেষ। আলোচনা সম্ভবত সফল হয়েছে। আমার শেষ অস্ত্র কাজে লেগেছে বলেই মনে হচ্ছে। পিচ্ছিল হেঁতাল গাছ বিছানো রাস্তা ধরে এগিয়ে দাঁড়ালাম তাদের সামনে। বললাম, আলোচনা শেষ হলো? সোহাগ বললো… ভাই, দুই জায়গায় চাপানো আছে আস্ত্র। কতোগুলো সেই হিসাব বলতে পারবো না। দুপুরে খেয়ে অস্ত্রগুলো আনতে যাবো। জিজ্ঞেস করলাম কতোদূর সেটা? বললো, একটা কাছেই আছে। আরও দুইটা অস্ত্রের প্যাকেট আনতে যেতে হবে বড় নিশানখালী। আরও দুই জায়গায় যেতে হবে? কতদূর সেটা? ফজলু বললো, বড় নিশানখালী খালে উঠে একটা পাশ খালের ভিতরে যেতে হবে। তারপর কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। যেতে আসতে তিন/চার ঘন্টা লেগে যাবে।
সময় নাই। সন্ধ্যার আগে সব জড়ো করতে হবে। একটা কাঁকড়া শিকারের নৌকা নেন। দু’জন অস্ত্রধারী যাবেন। সাথে আমি গেলে ভালো হতো। কিন্তু এদিকটা তখন সামাল দিবে কে? তাই বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন আলী ভাইকে পাঠালাম সেই দলের সাথে। জোয়ার শেষ। ভাটা চলছে। পানি তলানিতে নামার আগে ফিরতে হবে। দ্রুত রওনা দিন। ফজলু শেখ এর নেতৃত্বে নৌকা চললো নিশানখালীর পথে। আরেকটা জায়গায় বন্দুকের একটা প্যাকেট আছে। সেটাও আনতে পাঠাতে হবে।
অস্ত্রের হিসাবের পর গুলির হিসাব নিয়ে বসতে হবে। সেটা নিয়ে আবারও খেলতে হবে দস্যুদের সাথে? হতেও পারে। আবার আপসেও লুকানো গুলিগুলো বের করে দিতে পারে। বিষয়টি মাথায় রাখলেই হবে না। এই বেলার মধ্যে সেগুলো নিয়ে আসতে হবে। দূরের পথ হলে সময় মিলানো যাবে না।
মামুন কোথায়? সরদার কোথায়? পলিনকে খুঁজছিলাম ছবি তোলার জন্য। বৃষ্টির সময় সবাই ট্রলারে উঠেছে। তারপর ঘুম। মনে মনে ভাবছিলাম যে এখানে আমার কিছূ হয়ে গেলে কী হবে? রাজীবকেও খুঁজে বের করতে হবে। বেলায়েত সরদারের টিকিটিও দেখছি না গেলো দুই ঘন্টা ধরে। একজন জেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দিলাম অফিসের পিছনের জঙ্গল ধরে। কাঁদায় একাকার অবস্থা। আর গড়ান গাছের ঝোপের ভিতর দিয়ে হেঁটে অভ্যস্ত হইনি তখনও।
জেলে ভাই আমাকে হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু পর হাউমাউ কান্নাকাটি! কী হলো ভাই? বললেন, ডাকাতদের টাকা দিতে দিতে শেষ হয়ে গেলাম স্যার! বললাম, আমি আপনার স্যার হলাম কবে? কথা বলতে বলতে বুঝলাম, ওই জেলেরা ভেবেছে যে মাস্টার বাহিনী তাদের অপহরণ করেছে! তাদের ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেড়ে দিলে তারা আমাদের খবর কোথাও না কোথাও জানিয়ে দিবে। তাই দস্যুরা তাদের আটকে রেখেছিলো। পুরো বহরে একটি ফোন ছিলো সেটাও নিয়ে রেখেছিলো।
ওই জেলেরা আসলে ভাবতেও পারেনি যে কী হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে! অভয় দিলাম। বললাম, আমাদের দেখে কী ডাকাত মনে হয়? উনি বললেন, জলদস্যুদের কাছে মাঝে মাঝেই আপনাদের মতো সাহেবরা আসে। তারা কারা? কী করে? জেলে ভাই বললেন, প্রতিটি ডাকাত পার্টির সাথে উপরের লোকজনের যোগাযোগ থাকে। বড় পার্টির সাথে বড় মাছ ব্যবসায়ীর সম্পর্ক। আবার এদের যারা অস্ত্র-ট্রলার সাপ্লাই দেয় তারাও আসে মাঝে মাঝে। জিজ্ঞেস করলাম, এসে কী করে? বললেন, অস্ত্র দিয়ে যায়। দুই চারদিন থাকে। হরিণ শিকার করে। বড় বড় মাছ আর হরিণের মাংস নিয়ে ফিরে যায়। কখনও নগদ টাকাও নিয়ে যায় তারা। বললেন, কখনও সাংবাদিকও আসে এদের কাছে।
আমাকে কী মনে হচ্ছে? উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে হাঁটা দিলেন। আসলে সুন্দরবন তখন ছেয়ে থাকতো ভয় আর অবিশ্বাসে। এক দেখেও ওই জেলেরা আমাদের বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ডাকাত ধরে টাকা নিবে না সেকথা বিশ্বাস করাই কী করে?
কাঁদা আর গড়ানের শিকড়হুলোর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম খালের দিকে। ততোক্ষণে ভাটায় পানি নেমে গেছে অনেকটা।
ছবি: সামনে জেলে নৌকা। পিছনে জলদস্যুদের ট্রলার!