রূপান্তরের গল্প ৭৫ | Rupantorer Golpo 75

পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত ছিলো সেবার! | রূপান্তরের গল্প ৭৫

পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত ছিলো সেবার! | রূপান্তরের গল্প ৭৫ | Rupantorer Golpo 75 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৭৫ : কাঁকড়ার জেলেরা সব কালাবগীর। সাহসের কোনো সীমানা নাই তাদের। তবুও দস্যুদের সামনে আসলে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় এক একজন। সঙ্গী জেলে ভাইকে বললাম যে মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। বললেন, সমর্থন মানে কী? বললাম, সারেন্ডার করবে। ও! স্যালেন্ডার? না হেঁসে পারলাম না। লোকটার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম খালের পাশে।

সহযাত্রীরা সব ট্রলারে আটকা পড়েছে। বৃষ্টির সময় নামতে পারেনি। এখন ভাটা চলছে। পানি নেমে তলানিতে ঠেকেছে। নামতে হলে এখন কোমড় সমান কাঁদা ভাঙ্গতে হবে। কী করা যায়? সাথে সাথে ওই জেলে ভাই বললেন, টেনশন নিয়েন না, ব্যবস্থা করতেছি। জিজ্ঞেস করলেন আমি উঠবো কী না ট্রলারে! গেলে ভালো হতো। ক্যামেরার যন্ত্রপাতি আর আমার পরনের কাপড়টা বদলাতাম। বললেন, আমার ঘাড়ে ওঠেন! কী বলে এসব? ওইটুকু শরীরে আমার ওজন নিতে পারবেন? দস্যুদের ট্রলার থেকে হারুণ বললো, উঠে পড়েন মামা। বললাম, কাঁধে না উঠে যাওয়া যায় কী করে? পাশে রাখা নৌকাগুলো থেকে একজন বললো, ওখানেই দাঁড়ান। ব্যবস্থা করতিছি।

সাথে সাথে নৌকা থেকে কাঁদায় নেমে পড়লো ছেলেটা। তার বাড়ীও কালাবগী। ডিঙ্গি নৌকা একটার পর একটা সাজিয়ে সেতুর মতো পথ বানিয়ে ফেললো সে। ডাঙ্গা থেকে নৌকার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ট্রলারে গিয়ে উঠলাম। বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার বড় উদাহরণ পাওয়া যাবে এই সুন্দরবনে। মানুষের অভিযোজন করে টিকে থাকার এমন উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানা নাই।

বাঘ-কুমিরের ভয়কে জয় করে বনজীবীরা পুরো বন দাপিয়ে বেড়ায়। কিন্তু বনদস্যুদের ভয় তাদের জয় করা হয়নি। প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে চলার শক্তি ও বুদ্ধি তাঁদের জন্মগত। আমাদের পক্ষে তার সিকি ভাগ দক্ষতা অর্জনও সম্ভব না।

জেলে ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, দস্যুরা যদি সব সারেন্ডার করে কেমন হবে? উত্তর আসলো… সুন্দরবনের গাছে যতোদিন পাতা থাকবে, ডাকাত থাকবে ততোদিন! এই কথাটি বেশ প্রচলিত ছিলো সুন্দরবনের আনাচে কানাচে। গডফাদার আর কিছু সাহেব গোছের লোকজন ছড়াতো এসব কথা।

ও সরদার! সাড়া নাই। দেখি ডেক এর ভিতরে গভীর ঘুমে আমাদের বেলায়েত সরদার। তখন পেট ব্যাথা সমস্যা প্রকট ছিলো তার। ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছিলো না। তার সাথে রাত জেগে হয়রান। ইয়ামীন ভাই আগেই উঠেছেন। একটু খাওয়া সেরে তিনি ফজলু শেখ এর সাথে রওনা দিবেন। সরদারকে উঠিয়ে দিলাম। অন্যদেরও তৈরি হয়ে নামতে বললাম। শুধু মামুন ও ট্রলারের দুই সহযোগী থাকবে ট্রলারে। যেকোনো মুহুর্তে ছাড়ার প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ দিলাম।

পাশেই মাস্টার বাহিনীর দুটি ট্রলার রাখা পাশাপাশি। সশস্ত্র আর নিরস্ত্ররা একসঙ্গেই আছে। সন্দেহভাজনদের নজরে রাখছিলো সশস্ত্র দস্যু সুমন আর সুলতান কাকা। দস্যু হারুনের সঙ্গে আরেক হারুন ছিলো সেখানে। সেই হারুন মূলত ছোট ব্যবসায়ী। বাড়ি খুলনার কয়রায়। দস্যুদের সহযোগিতার অভিযোগ থাকায় জঙ্গলে পালিয়ে আছে সে দীর্ঘদিন। অস্ত্র হাতে ডাকাতি না করলেও সেই হারুনের নাম ছিলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায়।

এক কাপ চা জ্বালানো যাবে? দস্যুদের ট্রলারের বাবুর্চিকে বললাম, চা খাওয়ালে আসবো ওখানে। বাবুর্চি বলে, দুধ চা তো খাওয়াতে পারবো না মামা! বললাম সমস্যা নাই। একটু লাল চা খাওয়ান। লিকার কিন্তু জঙ্গলের মতো করে দিলে হবে না। হাল্কা লিকার দিবেন। আসলে একটু পরিবেশ হাল্কা করতেই চা খেতে চাইলাম। আমাদের ট্রলার থেকে নৌকার পর নৌকাতে হেঁটে পৌঁছে গেলাম।

চা-খেতে ভালো লাগছিলো না। রীতিমতো কালো রঙ এর চা। মানে চুড়ান্ত কড়া লিকার। সুন্দরবন ও উপকূলের জেলেদের হাল্কা লিকারে চলে না। রাত জাগা আর পরিশ্রান্ত শরীরে কড়া লিকারের চা না খেলে পোষায় না। তার ওপর পানিটা একটু নোনতা। উপভোগ না করলেও চুমুক দিলাম। সারেন্ডার করবে না যারা তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নাই। আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তারপরও অঘটন ঘটতে পারে। আক্রমণের কোনো শংকা তাদের কাছে থেকে না থাকলেও বাইরে থেকে আসতে পারে বিপদ। যদি এদের কেউ ফোন করে কাউকে বলে দেয় আমাদের অবস্থান তাহলে গোলাগুলি আর হতাহতের বিকল্প থাকবে না।

সশস্ত্র সাতজন দস্যুই ভালো যোদ্ধা হিসাবে পরিচিত। কেউ এবার এসে আক্রমণ করলে টিকে থাকার জন্য পাল্টা আক্রমণ করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিলো ভিতরে ভিতরে। আমি কিছুতেই কোনো রক্তক্ষণ চাই না। আবার সারেন্ডারের এই উদ্যোগ নষ্ট হোক সেটাই চাই না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top