শুরু হলো লুকানো অস্ত্র উদ্ধার অভিযান | রূপান্তরের গল্প ৭৬ | Rupantorer Golpo 76 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭৬ : চাপানো অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু হবে। দূরের অভিযানে নেতৃত্ব দিবেন ইয়ামীন ভাই, যমুনা টিভির বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি, আমার সহকর্মী। ডিঙ্গি নৌকা ভাসাতে হবে। একটা মজবুত নৌকা আগে থেকেই ভাসানো আছে, জানালো সোলাইমান। একটু বুদ্ধি করে আগেই সামনের খালে পাঠিয়ে রেখেছে সে। বললাম, ওই নৌকা থাকবে তো?
যা বলেছিলাম তাই হলো। নৌকা নিয়ে পালিয়েছে জেলেরা। সমস্যা নাই। এটা বড় দুশ্চিন্তার বিষয়! সুন্দরবনের দস্যুরা কিছু নিয়ম অনুসরণ করতো। যেমন কাউকে ধরলে তার কাছ থেকে মুক্তিপণ নিক বা না নিক, জানান দিয়ে তাদের ছাড়ে। কারণ পথে কোনো অঘটন ঘটে গেলে সেই দায় এই দস্যুদের ঘাড়ে আসে। দস্যুদের ডেরা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে কোনো কারণে মৃত্যু হলে বা হারিয়ে গেলে সেই দস্যুনেতাকে মার্ডার মামলা খেতে হয়। এমনিতেই মামলার অভাব নাই। মামলা খেয়ে ফেরারি হয়ে এক একজন বনদস্যুর জন্ম হয়। মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ দস্যুতায় নাম লিখিয়েছিলো এভাবেই। সেই গল্প লিখবো একদিন।
পাশাখালীতে কয়েকটি কাঁকড়ার নৌকা ছিলো। সেখান থেকে আরেকটি নৌকা ঠিক করা হলো। দ্রুত কাঁদা থেকে নামিয়ে ভাসানো হলো সে নৌকা। ফজলু শেখ এর সঙ্গে তাতে উঠে বসলেন ইয়ামীন ভাই। তখন সম্ভবত দুপুর ১২টার মতো বাজে। বললাম বিকাল চারটার মধ্যে ফিরে আসবেন। সেই যাত্রায় শাহীন নামের আরেক দস্যু সঙ্গী হলো। তাদের রওনা করিয়ে ফিরলাম ফরেস্ট অফিসে। এবার সঙ্গে করে বেলায়েত সরদারদের নিয়ে গেলাম।
বাগেরহাটের মানুষ হলেও ইয়ামীন আলী সুন্দরবনে নতুন। দূর সুন্দরবনের কিছুই চিনেন না। দস্যুদের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় সেবারই প্রথম। অবশ্য সকাল থেকে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে দস্যুদের। সেই ভরসা থেকেই ঝুঁকির কাজটিতে পাঠালাম তাঁকে।
পাশাখালী খাল ধরে আধা ঘন্টা লাগে নিশানখালীর ভাড়ানীতে উঠতে। হাতে বাওয়া নৌকায় সময় লাগে কম। ভাড়ানী খেকে বেরিয়ে বড় নিশানখালী যেতে হাতের ডানে বামে অসংখ্য ছোট খাল আছে। হাতের বামে তেমনই এক খালে ঢুকলো নৌকা। দস্যু ফজলু শেখ ওই জায়গাটা চিনে। সোহাগ আকনের বাইরে শুধু সেই জানতো কোথায় লুকানো আছে অস্ত্রের বস্তা।
নিশানখালীতে দিনের বেলা চলাফেরা খুবই ঝুঁকির। দস্যুপ্রবণ ওই অঞ্চলে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সশস্ত্র দস্যুদের চলাফেরা আরও বেশি ঝুঁকির। অন্য দস্যুদল থাকতে পারে, কোস্টগার্ড বা RAB এর অভিযানও থাকতে পারে। আদাচাই ফরেস্ট অফিসের টহলও থাকে। একটিমাত্র অস্ত্র নিয়ে সেই নৌকা যাত্রা তাই কোনো ভাবে নিরাপদ ছিলো না। কিন্তু উপায়ও ছিলো না।
ছোট খাল ধরে মিনিট দশ মিনিট। তারপর ডাঙ্গায় উঠে আরও দশ মিনিটের হাঁটাপথ। একটি বড় বাআন গাছ ছিলো নিশানা। সেখান থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি বস্তা চাপানো আছে। কুড়াল আর দা দিয়ে খুঁড়ে বের করা হলো প্রথম বস্তাটি। নিল পলিথিনে মোড়ানো। কয়েকটি বন্দুক খুলে লুব্রিকেন্ট দিয়ে রাখা। পাশের আরেকটি মাঝারি বাইন গাছের পাশে আরেকটি গর্ত করা হলো। সেখান থেকে বের হলো ছোট একটি ড্রাম। তার ভিতরে গুলি রাখা। তুলা দিয়ে ঠেঁসে ৫০০ বন্দুকের গুলি রেখেছিলো ওই প্লাস্টিকের ড্রামে। পুরো কাজটি করে ফিরে আসতে তাদের সময় লেগেছিলো পাঁচ ঘন্টা। সেই উৎকণ্ঠার কোনো তুলনা হয় না। আরেক জায়গায় আরেকটি প্যাকেট লুকানো আছে। সেটাও আনতে হবে।
ইয়ামীন ভাইদের রওনা করিয়ে ফিরে এসেছি ফরেস্ট অফিসে। আরেকটি অস্ত্রের প্যাকেট আনতে যাবে কে? একটি খালের দোয়ায় পুঁতে রাখা সেই প্যাকেট। পানিতে ডুব দিয়ে খুঁজতে হবে। ওদিকে নাকি ভাঙ্গণ লেগেছে। সঠিক জায়গাটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। বুঝলাম সেই অস্ত্রের প্যাকেটটি বের না করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। বললাম, ওই প্যাকেটটাও বের করতে হবে! মাস্টার বললো, সে নিজে যাবে।
মাস্টারকেও পাঠিয়ে দিবো অস্ত্র তুলতে। ওদিকে ফজলু গেছে আরেক জায়গায়। দুইজন সশস্ত্র দস্যু আছে বড় নদীর পাশে। ট্রলার পাহাড়ায় আছে সোলাই আর সুমন। আমার সাথে থাকবে শুধু সোহাগ। মাত্র একজন সশন্ত্র দস্যুকে পাশে রেখে অনিরাপদ অনুভব করছিলাম। মাস্টার বললো, ও ভাই, আমরা যাবো আর আসবো। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আধা ঘন্টা হেঁটে গেলেই সেই জায়গা। সঙ্গে যেতে চাইলাম। দস্যুনেতা মাস্টার চোখের ইশারায় না করলেন। আরেক দস্যু সুলতান কাকাকে সঙ্গে নিয়ে মাস্টার হাঁটা দিলো।
চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি বসে থাকলাম পাশাখালীর পুকুর পাড়ে।