ফরেস্টের নৌযান, নির্বিকার দস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৮১ | Rupantorer Golpo 81 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৮১ : মুহুর্তেই দস্যুনেতা মাস্টারের চোঁয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সবার নজন পশুর নদীর উজানে। কে হাত চলে গেলে বন্দুকের ট্রিগারে! পশুর নদীর পাশে গড়ান বন। গাছগুলো ছোট হলেও নিজেদের আড়াল করা যায়। দূর থেকে দেখছি সাদা কেবিন ক্রুজার। পিছনে ঝুলানো স্পিডবোট!
সুন্দরবনে সাদা রঙ এর নৌযান মানেই বিপদ! বিপদ দস্যুদের জন্য, চোর-ডাকাতদের জন্য। আমাদের জন্য বিপদ না। কিন্তু দস্যুরা সঙ্গে থাকলে সবার জন্যই বিপদ। গোলাগুলি হলে নিজেরা মরতে পারি। পাল্টা গুলিতে ওদিকের কেউ গুলিবিদ্ধ হলে বা মারা গেলে তো সোজা মার্ডার কেইস খেয়ে যাবো। তখন বিপদের কোনো সীমা থাকবে না। সত্যি কথা বলতে তখনও সুন্দরবনে আমার কাজ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ ছিলো।
অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা মাথায় আসছে। কিন্তু ভাবনার মধ্যে থেকে বিপদ বাড়ানোর সুযোগ নাই। বললাম কী করবো আমরা এখন? মাস্টার বললো, আপনি টেনশন করেন কেন? হাতে বন্দুক আর গুলি আছে এখনও। তেমন কিছু হলে গোলাগুলি হবে। জীবন থাকতে এখানে ভিড়তে দিবো না। বললাম, মাথা গরম করা যাবে না।
কারা ওরা বুঝতে পারছেন? স্পিডবোট নিয়ে টান দেয়ার কোনো লক্ষণ দেখেন? না, স্বাভাবিক গতিতে আসছে। মাস্টার বললো, ওটা ফরেস্টের স্মার্ট টিম। বন বিভাগের বিশেষ দলের নাম স্মার্ট টিম। নিয়ম করে এই বিশেষ টিম সুন্দরবনে অভিযান চালায়। তার মানে ওরা কোস্টগার্ড না? সিওর তো? পাশ থেকে এক জেলে বললো, কোস্টগার্ড না, ওটা স্মার্ট টিম। তো ওদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র থাকে না? থাকে না মানে? জেলে ভাই বললো, স্মার্ট টিম হচ্ছে ফরেস্টের সবচেয়ে বিপজ্জনক দল। যখন তখন গুলি করে বসে।
পুকুর পাড়ে তাকিয়ে দেখি সুলতান কাকার কোনো বিকার নাই। অন্যরাও নির্ভার। বললাম, আপনারা একটু আড়াল হন! কাকা বললো, ফরেস্ট আমাদের আশেপাশে ভিড়বে না। কেন ভিড়বে না? হাসতে হাসতে বললো, দুইটা মেশিন রেডি করা আছে। সাতজনের হাতে মেশিন। গুলি আছে কয়েক হাজার। কতোক্ষণ যুদ্ধ করবে ওরা? বন বিভাগ তো আমাদের সাথে লড়াই করে না। বরং আমাদের দেখলে ওরা সরে যায়।
পাশ থেকে আরেক দস্যু বলছিলো, প্রতিটা ফরেস্ট অফিসে মাসে মাসে টাকা দেই। বিপদে আপদে চায়, তখনও দেই। বাজার ফুরিয়ে গেলে আমাদের কাছে চায়, ওষুধ পানিও দেই আমরা মাঝে মাঝে। ফরেস্টের সাথে আমরা সাধারণত ঝামেলা করি না। তারাও করে না। এড়িয়ে যায়।
এদিকে আমার সহকর্মীদের কাউকে দেখছি না। বেলায়েত সরদারসহ অন্য সহযাত্রীদেরও খোঁজ নাই। সবাই ট্রলারে। দুই দস্যুর স্ত্রী সন্তানেরা আছে। তারা ফরেস্ট অফিসের ভিতরে। সবাইকে ডাকতে বললাম, সতর্ক থাকতে বললাম। সারেন্ডার করবে না যারা তাদের দিকে নজরদারি বাড়াতে বললাম। জেলেদের মধ্যে হারুন নামের একজন ছিলো। দস্যুদের বিশ্বস্ত, বাড়ি কয়রা। সবার ওপর নজরদারির দায়িত্ব দিলাম তার ঘাড়ে। সুলতান কাকা আমাকে দেখে আর হাঁসে। বললাম, ও কাকা হাঁসেন কেন? বললো, আপনারে দেখে হাঁসি। এতো সাহসী মানুষ হয়ে কেমন ভয় পাচ্ছেন! বললাম, ভয় আমার জন্য পাচ্ছি না কাকা, আপনাদের জন্য আমার এতো টেনশন।
মিনিট পনেরো পরে আবার গেলাম নদীর পাড়ে। সেখানে সোহাগ আছে, সাথে আরও দুইজন সশস্ত্র দস্যু। বেশ আয়েশ করে গাছে হেলান দিয়ে গল্প করছে তারা। দস্যু দলের সদস্যদের এমন গা ছাঢ়া ভাব দেখে মনে সাহস এসেছে। ওদিকে অনেক কাছে চলে এসেছে নৌযানটি। এবার নিশ্চিত ওরা ফরেস্টের স্মার্ট টিম। ওরা অতিক্রম না করা পর্যন্ত এখানেই থাকবো।
কেবিন ক্রুজারটি আসছে একদম কূল ঘেঁসে। চাইলেবগী পার হয়ে আরও কূলের দিক ধরে এগুচ্ছে তারা। জোয়ার ছিলো বলে গতি কম। তাই আসতে দেরি হচ্ছে। সোহাগ বললো, আমাদের এখানে থাকার বিষয়ে কিছু জানে না ওরা। যদি সেই খবর পেতো বা অভিযান চালানোর পরিকল্পনা থাকতো তাহলে এতো তীর ধরে এগুতো না। অন্তত গুলির রেঞ্জ এর বাইরে দিয়ে চলতো তারা। কথা বলতে বলতে একদম কাছে চলে আসলো কেবিন ক্রুজার।
পিছনে স্পিডবোটটি একই ভাবে বাঁধা। ঢেউ আর স্রোতে পানির উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে সেটি। কেবিন ক্রুজারের বাইরে কোনো সশস্ত্র অবস্থান নাই। দুইজন বনকর্মী অলস ভঙ্গীতে বসে আছে সামনে। আমি সরে আসলাম, নিজেকে একটু আড়াল করলাম। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তীরে দাঁড়ানো দস্যুদের দেখলো তারা। হাত তুলে কুশল বিনিময় করে একই গতিতে নেমে গেলো স্মার্ট টিম। বুঝলাম সুলতান কাকারা কেনো এতো নির্ভার! মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার।