রূপান্তরের গল্প ৮৪ | Rupantorer Golpo 84

অসতর্ক-বেখেয়াল দস্যুরা গুলি করতে গিয়ে দেখে চেম্বারে গুলি নাই | রূপান্তরের গল্প ৮৪

অসতর্ক-বেখেয়াল দস্যুরা গুলি করতে গিয়ে দেখে চেম্বারে গুলি নাই | রূপান্তরের গল্প ৮৪ | Rupantorer Golpo 84 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৮৪ : জলদস্যুদের ট্রলারটি দেখতে সাধারণ নয়। দূর থেকে দেখলেই বুঝা যায়। এই নৌযানটি দেখলে বুক কেঁপে ওঠে জেলেদের। সুন্দরবনে চলাফেরার সময় নিজেরাও সতর্ক থাকতাম যাতে দস্যুদের নজরে না পড়ি। তখন সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল মাস্টার বাহিনী। অন্য দস্যু বাহিনীগুলোও এই মাস্টারের ভয়ে থাকতো কোণঠাসা। মাস্টার বাহিনীর ট্রলার বহর তখন সুন্দরনের ত্রাশ। বঙ্গোপসাগরের জেলেরাও তটস্থ থাকতো একই কারণে। বনদস্যুদের ভয়ে তখন জঙ্গল-উপকূলের জেলেরা সন্ধ্যায় বাতি জ্বালতো না। সূর্য ডোবার আগে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতো। আশ্রয় নিতো ছোট খালের আগায়। রাতের বেলা তারা কথা বলতো ফিসফিস করে। অথচ দোর্দণ্ড প্রভাবশালী সেই দাপুটে দস্যুদের চেহারা পাল্টে গেছে। চোখের সামনে দেখছিলাম সেই রূপান্তর।

দস্যুরা তখন সারেন্ডারের জন্য অস্ত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের পুকুর পাড়ে কর্মব্যস্ত সবাই। বৃষ্টি আসার আগে গোছগাছ শেষ করতে সবাই মিলে হাত লাগিয়েছে সেই কাজে। অস্ত্রগুলো জোড়া লাগিয়ে, পরিস্কার করে একটা একটা করে রাখা হচ্ছিলো বন বিভাগের জেটিতে। গুলিগুলো গণনার সময় নাই। প্রচুর গুলি। জেলেরা জানতেও পারলো না যে তাদের নিত্য আতঙ্কের অবসানের সূচনা হচ্ছে সেদিন থেকে।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বড় একটা বৃষ্টি আসবে আবার। দ্রুত হেঁটে গেলাম ট্রলারের দিকে। গড়ান বনের ভিতর দিয়ে হাঁটাপথটি ততোক্ষণে চিনে গেছি। এমনিতে বাঘের ঝুঁকি আছে। তবে এতো মানুষ যেখানে, সেখানে মামাদের না থাকারই কথা। তবুও ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ নাই। কারণ ওই পথেই বাঘের পায়ের তাজা ছাপ দেখেছি সকালে। পুকুর পাড়েও এক/দুই দিন আগে বাঘ মামা এসেছিলো। বন্দুকধারী দস্যু হারুন আমার সঙ্গে হাঁটছিলো। বললাম বাঘ সামনে পড়লে কী করবে? বললো, গুলি করে দিবো মামা। গুলি করতে পারো? বেশ অপমানীত হলো সে। বললো, এতো বছর ডাকাতি করতিসি, গুলি করা জানবো না? বললাম তোমার বন্দুক তো একনলা। একটা গুলি দিয়ে বাঘ ঘায়েল করতে পারবে? বললো, ও কোনো বিপার না মামা। বাঘ-টাঘ সামনে পড়লে তখন দেখবেন কেমন ফাইটার আমি!

হাঁটছিলাম বেশ জোরেসোরে। বড় বৃষ্টি নামার আগে গিয়ে ফিরতে হবে। পথে গল্প করতে করতে হঠাৎ দাঁড়ালাম। হারুনকে বললাম যে ধরো এখন সামনে বাঘ। কী করবে? সাথে সাথে বন্দুক তুলে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখলো সে। গুলি লোড করতে গিয়ে দেখলো চেম্বারে গুলি নাই। বললাম, তোমরা যে কেমন ফাইটার আমি সেটা জানি। ছেলাটা তখন লজ্জায় শেষ। বললাম গোলাগুলি করছো কয়বার? ঝাইলোর খালের সেই বন্দুক যুদ্ধের সময় তোমাকে তো দেখলাম না। হারুন এবার সত্যি কথাটা বললো। আসলে কয়েক বছরের দস্যু জীবনে তেমন একটা গুলি করা লাগেনি তার। কারণ সে সব সময় বড় দস্যুদলে কাজ করেছে। মিশুক স্বভাবের কারণে সবাআ পছন্দদ করতো তাকে। দলের ভিতরে সবার চুল কাটা আর সেভ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিলো তার। দস্যুনেতাদের ব্যক্তিগত কাজ কারবারও ছিলো তার।

গল্প করতে পৌঁছে গেলাম পিছনের খালে। জোয়ার শেষ। ভাটা হচ্ছে। নোঙ্গর করা দস্যু ট্রলারটি ভাসছে এর স্রোত ঘুরে যাওয়ার সাথে সাথে একটু করে ঘুরছে। কেবিনগুলো পলিথিন দিয়ে ঢাকা। ডিঙ্গি নৌকা করে গিয়ে উঠলাম তাতে। বৃষ্টির কারণে গলুয়ের মাটির চুলাটি ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। দস্যুরা সব কেবিনের ভিতরে।

সোলাইমান কোথায়? সুমন ভাই কোথায়? বাঁকী লোকজন সব কই? ভিতর থেকে মাথা বের করলো সোলাই। বললো, কাকু আমরা রেডি। বললাম দুপুরের খাবারের কী অবস্থা? খাইছো সবাই? ভিতর থেকে ফজলু বললো, সবাই খাইছে। খায়নি শুধু বেলায়েত সরদার। পাশেই বাঁধা সরদারের ট্রলার। বললাম, ও সরদার, খাবেন না? পেটে একটু সমস্যা চলছে ভাই। সুখ পাচ্ছি না কিছুতেই। তাই খাওয়া দাওয়াও করতিসি না ভাই। বললাম না খেলে চলবে কী করে? ওপাশ থেকে মামুন বললো, কোনো অসুবিধা নাই। বেলায়েত ভাই রেস্ট নিক। আমরা তো আছি। বললাম, রেস্ট নাও। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে সবাই পজিশনে চলে যাবে। ভাটা হচ্ছে।

মাঝ ভাটার আগেই ট্রলারগুলো সরাতে হবে। তা না হলে সময় মতো বের হতে পারবো না। একই নির্দেশনা দিলাম দস্যুদেরকেও। সোলাইমান বললো, কাকু আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের সেই হিসাব আছে। হিসাব থাকলে সবাই কেবিনের ভিতরে কেন? বড় বৃষ্টি তো এখনও আসেইনি। বাইরে থেকে যে কেউ এসে তোমাদের অ্যাটাক করতে পারবে। কেমন সতর্ক তোমরা? বাইরে একজনও পাহাড়ায় নাই। শেষ সময়ে এসে বিপদ বাড়িও না। দুইজন বের হয়ে ট্রলারের দুই দিকে পাহাড়ায় বসো।

সাথে সাথে কেবিনগুলো থেকে পলিথিনের পর্দা সরানো হলো। সবাই উঠে দাঁড়ালো। সশস্ত্র আর নিরস্ত্র দস্যুরা একসাথেই সেখানে। যারা সারেন্ডার করবে না তাদের চেহারাগুলো মলিন, সন্ত্রস্ত। বললাম, আগামী এক ঘন্টার মধ্যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন আপনারা। সারেন্ডার করবেন? নাকী দস্যুতা চালিয়ে যাবেন? এই দফায় আপনাদের কোনো ঝুঁকি নাই, কেউ ধরবে না। তবে এর পর কী হবে জানি না আমি। বলেই ফিরতি পথ ধরলাম। সেই গড়ান বনের ভিতর দিয়ে ফিরলাম ফরেস্ট অফিসে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top