রূপান্তরের গল্প ৮৬ | Rupantorer Golpo 87

অসম্মান আর অপমান! অসহায় বনকর্মীরা | রূপান্তরের গল্প ৮৭

অসম্মান আর অপমান! অসহায় বনকর্মীরা | রূপান্তরের গল্প ৮৭ | Rupantorer Golpo 87 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৮৭ : মনটা আমারও খারাপ। কিছুতেই চাইছিলাম না আর শিকার হোক। কিন্তু কথা শুনলো না তারা। আগেই নিষেধ করেছি। কিন্তু শিকারের নেশা খুব খারাপ। বৃষ্টির মধ্যে যখন সবাই ফরেস্ট অফিসের ভিতর, তখনই একজন বেরিয়ে যায়। আসলে বনের ওই দিকে হরিণ শিকার করতে বেশি দূরে যাওয়া লাগে না। আশেপাশে কেওড়া বাগান থাকলেই হয়। এছাড়া ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বেয়ে গেলেও সামনে পড়বে হরিণ। শুধু একটা গুলির ব্যাপার। দস্যুদের বনবদুকের অভাব ছিলো না। গুলিও ছিলো অগণিত।

আবার বকা দিলাম তাদের। বললাম, নিজেরা একটু মাছ ধরতে পারতে! ওরা বললো, মরা গোন-এ মাছ পাচ্ছেন কোথায়? আর জঙ্গলে এখন কাঁকড়ার নৌকা ছাড়া কিছু নাই। মাছ ধরার নৌকা খুঁজলে পাবেন না একটাও। বাবুর্চি বললো, আপনের জন্য মাছের তরকারি রাখছি। বললাম, আমার তো কিছু একটা খেলেই চলে। কিন্তু শিকারটা করলো কে?

একটা শুভ কাজে যাচ্ছি আমরা। আর কোনো উল্টা পাল্টা কাজ করবেন না। অনেক বছরের চেষ্টার পর এই সুযোগ এসেছে আপনাদের। নষ্ট করা যাবে না। সবাই যার যার কাজে যান। সবকিছু গুছিয়ে নেন।

মাস্টার কিংবা সোহাগকে বললাম, সদস্যদের সবাইকে আরেক বার জিজ্ঞেস করেন যে সারেন্ডার করবে কী না! এটা জীবন মরণের বিষয়। ওরা হয়তো ভয় পাচ্ছে, ভরসা করতে পারছে না। কিন্তু আপনারা তো বুঝতে পারছেন যে বেঁচে যাওয়ার এমন সুযোগ জীবনে বার বার আসে না।

দস্যুরা কাজ ভাগ করে নিলো। শেষ সময়ের কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। বিশেষ করে অস্ত্র আর গোলাবারুদ গুছিয়ে নিতে হবে। একটি গুলির খোসাও ছেড়ে যাবো না। নেমে পড়লো তারা। বললাম, আধা ঘন্টার মধ্যে যারা সারেন্ডার করবেন তারা পুকুর পাড়ে আসবেন।

আমার সহযাত্রীদের ডেকে পাঠালাম। বেলায়েত সরদার, ইয়ামীন আলী, আহসান রাজীব, মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আর আমার ভিডিওগ্রাফার বায়েজিদ ইসলাম পলিন একসাথে হলাম। হাঁটতে হাঁটতে পশুর নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, সময় ঘনিয়ে এসেছে। সবাই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন। ফরেস্ট অফিস, দস্যুদের ট্রলার, দস্যুদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখবেন। বিশেষ করে যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদের থেকে চোখ সরাবেন না। সন্ধ্যা বেলা মানুষের মনও বদলায়, দুর্ঘটনা ঘটার শংকা তখনই।

বেলায়েত সরদার চলে গেলেন ট্রলারে। আমাদের ট্রলারের সহযোগীদের নিয়ে দস্যুদের ট্রলারে নজরদারি শুরু হলো। ইয়ামীন আলী ও আহসান রাজীবকে দায়িত্ব দিলাম ফরেস্ট অফিসের চারপাশ নজরে রাখতে। নিজাম উদ্দীনকে রাখলাম পুকুর পাড়ে দস্যুনেতাদের সঙ্গে। কাউকে ফোন করছে কী না, কে কী বলছে সব নজরাদারিতে রাখলেন তিনি। আমি গিয়ে বসলাম ফরেস্ট অফিসের সিঁড়িতে।

হেঁতাল গাছ দিয়ে করা পথের এক পাশে শিকার করা হরিণটি রাখা। মাটির উপর পড়ে আছে। কী যে মায়া লাগছিলো! মেজাজটা বার বার খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এসময় মাথা গরম করা যাবে না। পাশে ওসি সাহেব বসা।

বন টহল ফাঁড়ীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও বিমর্ষ। সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে। শিকার প্রতিরোধের দায়িত্ব তাঁদের। আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথা। কিন্তু কী অসহায় অবস্থা তাঁদের। বলছিলেন, এটা সুন্দরবনের নিয়ম হয়ে গেছে। চোখের সামনে অনিয়ম দেখি। মুখ বন্ধ করে থাকি, চোখে দেখি না, কানেও শুনি না। মন খুলে কথা বলতে লাগলেন তিনি।

ওসি সাহেব বলছিলেন এক নাগাড়ে। মাস্টার বাহিনী তবু বেশ ভদ্র। অসম্মান করে না। অন্য বাহিনীগুলো বেশি খারাপ। দুর্ব্যবহার করে। সুন্দরবনে অন্তত এক ডজন অফিস আছে যেখানে দস্যুরা এসে আমাদের বের করে দেয়। কিছু বললে গালি-গালাজ করে। অপমানের শেষ নাই ভাই। ইউনিফরম পড়ে এসব দেখলে কষ্ট লাগে। বনদস্যুদের দমন করবো কী! উল্টো তাদের ভয়ে জড়োসড়ো থাকি। ওদের ভয়ে আমাদের ক্যাম্প-এ অস্ত্র রাখি না আমরা। খালি হাতে থাকলে জঙ্গলে ডিউটি করা যায়?

আপনাদের স্যারদের বলেন না আপনারা? চুপ থাকলেন। স্যারদের নিয়ে কিছু বলবেন না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, এখানে কী কী অপরাধ হয়? বললেন, অয়াশ্রমে দেদারসে মাছ ধরা চলে, নিষিদ্ধ জাল দিয়ে চলে মাছ শিকার, কাঁকড়ার জেলেরা থাকে সারা বছর, গাছ চোরের বিরাট গ্রুপ আসে দূর দূরান্ত থেকে। হরিণ শিকার তো প্রতিদিনই চলে। দস্যুরা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। একটা দল যায়, আরেকটা আসে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার চলে গোন-মরাগোন মিলিয়ে। বাঘ শিকারের ঘটনা ঘটে? বললেন, জানি না।

বনরক্ষীদের নিয়ন্ত্রণে তেমন কিছু ছিলো না তখন। অপরাধীদের ধরতে গেলে উল্টো তেড়ে আসে তারা। একবার গাছ চোর ধরতে গেলাম। ওরা ঘেরাও দিয়ে ফেলে। পুরো একদিন আটকে রাখে। অনেক অনুরোধের পর ছাড়তে রাজি হয়। সাথে অস্ত্র না থাকলে কেউ পাত্তা দেয়? ওসি সাহেব বললেন, পাশাখালী, আদাচাই, চরাপুটিয়া, ভ্রমরখালীসহ দূরের ফরেস্ট অফিসগুলোর পরিবেশ আমাদের জন্য বৈরী। তাই কোনো রকমে লোকালয়ের কাছের কোনো অফিসে পোস্টিং পেলে বাঁচি। অপমানের এই জীবন খুব কষ্টের, স্যারদের বুঝানো যায় না!

শিকার করা হরিণ কাটাকুটি করতে সময় লাগলো না। আধা ঘন্টার মধ্যে শেষ। মাথা আর চামড়াটা পাশেই পুঁতে ফেললো তারা। বন বিভাগের পুরনো কর্মীরা এসব অনাচারের সাক্ষী। নতুন বনকর্মীরা সেই দিনের কথা জানেন না। অনুভবও করবেন না।

(ছবিটি পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের। ২০২২ সালের)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top