রূপান্তরের গল্প ৮৮ | Rupantorer Golpo 88

বন্দুক চালানো শিখে নিলাম, প্রয়োজনে ব্যবহার করবো | রূপান্তরের গল্প ৮৮

বন্দুক চালানো শিখে নিলাম, প্রয়োজনে ব্যবহার করবো | রূপান্তরের গল্প ৮৮ | Rupantorer Golpo 88 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৮৮ : অস্ত্রগুলো গোছানোর কাজ প্রায় শেষ। বিপত্তি বাধলো দুটি অস্ত্র নিয়ে। লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো জোড়া লাগাতে লাগাতে শেষে এসে দেখা গেলো দুই অস্ত্রের অর্ধেক আছে, অর্ধেক নাই। বিষয়টা কী? বন্দুকের বাঁকী অংশ কই গেলো? একটি একনলা বন্দুক, আরেকটি দোনলা। সম্ভবত সিকান্দার। একটিরও ট্রিগার থেকে উপরের অংশ নাই। বললাম, ভালো করে খোঁজ নেন কোথাও থেকে গেলো কী না!

হাসতে হাসতে মাস্টার বললো, ও ভাই, বাঁকীটা পাবেন না। ওই অস্ত্রগুলো আমরা কেড়ে আনছি জাহাঙ্গীর বাহিনীর কাছে থেকে। গত সপ্তাহে ওদের অ্যাটাক করছিলাম ভ্রমরখালীতে। ফরেস্ট অফিসে উঠছিলো জাহাঙ্গীর। খবর পেয়ে আমরা গেলাম। ট্রলার দূরে রেখে নি:শব্দে হেঁটে গিয়ে আচমকা অ্যাটাক করলাম। সবাই দিলো দৌড়। ট্রলারে ফরেস্ট অফিসের ভিতরে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ময়না আর সন্তান ইয়াসিন ছিলো। তাই পাল্টা আক্রমণের কথা চিন্তাও করেনি তারা। তড়িঘড়ি করে জাহাঙ্গীর তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যায়।

আরেক খালে ছিলো তাদের ট্রলার। সেখানে আমাদের আরেক দল আক্রমণ করে। ওরা ট্রলারে বসে বন্দুক পরিস্কার করছিলো। মনে হয় চাপানো অস্ত্র বের করে জোড়া লাগাচ্ছিলো। সোহাগ বললো, ওই দলে মাস্টার ছিলো। পানিতে ডুবে অ্যামবুশ করছিলো সে। মাস্টার বললো, একটা গুলি করতেই সব দৌড়। আসলে কাউকে মেরে ফেলা উদ্দেশ্য ছিলো না। ভয় দেখায়ে অস্ত্রগুলো কেড়ে নেওয়াই ছিলো লক্ষ্য।

তারপর কী হলো? ট্রলারের দস্যুরা ঝাঁপ দিয়ে পড়লো পানিতে। তাদের দুই জনের হাতে দুটি বন্দুকের নল ছিলো। পরিস্কার করছিলো। ওই দুটি নল ওখানেই থেকে গেছে। জাহাঙ্গীর সারেন্ডার করলে ওই নল দুটোও পাবেন। বললাম, জাহাঙ্গীর করবে সারেন্ডার? জীবনেও না।

জাহাঙ্গীর বাহিনী নামের দস্যুদলটি ছিল কুখ্যাত। জেলেরা ভয়ে কাঁপতো। প্রচুর মারপিট ও অত্যাচার করতো জাহাঙ্গীর। এক সপ্তাহ আগে মাস্টার বাহিনীর সেই আক্রমণের কারণে ক্ষিপ্ত সে। পাল্টা আক্রমণের ক্ষমতা ছিলো না তার। তবে সারেন্ডার করছে জানলে কিছু একটা করার চেষ্টা করবেই সে। আর সেজন্যই সাতজন সশস্ত্র দস্যু ছিলো সতর্ক। সতর্ক ছিলাম আমরাও।

মাস্টার বললো, আপনেরাও হাতে অস্ত্র রাখেন। বিপদ আপদ আসলে ব্যবহার করবেন। আমি হাসতে হাসতে শেষ। বললাম, আমাদের হাতে অস্ত্র নিতে হবে? আপনারা তাহলে কী করবেন? ঝামেলা হলে শুধু নিজের জীবন বাঁচাবেন? ঝাইলোর খালের বন্দুক যুদ্ধের মতো করে সবাই আবার পালাবেন না তো? পরিবেশটা একটু হাল্কা হলো। তবে সতর্ক ছিলাম সবাই। ফরেস্ট অফিসের জেটিতে রাখা সারি সারি অস্ত্র। তখন রোদে শুকানো হচ্ছিলো। অস্ত্র চালাবো না নিশ্চিত। কিন্তু বিষয়টা জেনে রাখা দরকার। শটগানটা নিয়ে চালানো শিখে নিলাম। বুলেট ছাড়া লোড করে ট্রিগার চাপলাম কয়েক বার। বন্দুক চালানো শিখে নিলাম দুই মিনিটে। আইনসিদ্ধ না হলেও জীবন হুমকিতে পড়লে ব্যবহার করবো। অস্ত্রগুলো রেখে দিলাম সেখানেই। পলিন সুন্দর করে কয়েকটা ছবি তুললেন।

বিকাল ৪টা। জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হবে তখন। আমরা যেখানে ছিলাম সেই পাশাখারীতে হবে ভাটা শুরু। তার মানে এই না যে মংলাতেও একই সময়ে ভাটা হবে। জোয়ার বা ভাটা আগে হয় সাগরে। উজানে হয় পরে। মানে মংলায় ভাটা শুরু হতে হতে সন্ধ্যা ছয়টা। রাত ৮টায় যদি RAB এর লঞ্চ ছাড়ে তবে ভদ্রা আসতে আসতে ১২টা বাজবে। আমরাও এমন ভাবে রওনা দিবো যাতে রাত ১২টার দিকে ভদ্রা পৌঁছানো যায়।

জোয়ার হলে টেনশন বাড়ে। যথারীতি পাহাড়া বাড়ানো হলো। এবার ওখানে থাকা জেলেরাও সামিল হলো। বিকাল হতে হতে দস্যুদের জড়ো করা অস্ত্র দেখে বেশ খুশি তারা। ডাকাত সারেন্ডার করবে তাহলে! তিনজন জেলে আর একজন সশস্ত্র ডাকাতকে নিয়ে হাঁটা দিলাম নদীর দিকে। এবার নজর রাখতে হবে দক্ষিণ দিকে। জেলেদের একজন খুশিতে জড়িয়ে ধরলো হাঁটতে হাঁটতে।

কয়রার সেই জেলে বললো, সুন্দরবনের ডাকাতগুলো উঠে গেলে কী যে উপকার হবে আমাদের! কিন্তু সেটা তো অসম্ভব ব্যাপার। বিশ্বাস হয় না। বললাম, সবচেয়ে বড় ডাকাত দল সারেন্ডার করছে সেটা বিশ্বাস হচ্ছে? বললো তা হচ্ছে। পাশের জেলে একটু প্রবীন। বললেন, সুন্দরবনে গাছের পাতা যতোদিন আছে, ডাকাত থাকবে ততোদিন। আপনারা কিচ্ছু করতে পারবেন না। বললাম, না পারি, চেষ্টা তো করতে পারি না কি? বলতে বলতে নদীর পাড়ে চলে আসলাম।

ভরপুর দখিণা বাতাস বইছে। আকাশ পরিস্কার। সূর্যের তেজ নাই বললেই চলে। মরা গোন বলে নদীতে জেলেদের বহর নাই। পশুর নদী ধরে জেলেদের চলাফেরাও নাই। সুন্দরবনে মানুষ না দেখলে কেমন কেমন লাগে! অন্ধকার হতে হতে অর্ধেক জোয়ার হবে। নদীর দুই পাশে সারাক্ষণ নজরে রাখবেন আপনারা। তরুণ ওই জেলে বললো, আপনি মামা নিশ্চিন্তে থাকেন। রাত হলেও সমস্যা নাই। চাঁদের আলো থাকবে। চোখও খোলা থাকবে। বলতে বলতে হেসে দিলো সে। মনে হলো মনটা খুশি। আসলে সকালে তারা ভেবেছিলো যে দস্যুরা তাদের অপহরণ করেছে। কিন্তু ঘটনা যে সেটা নয় ততোক্ষণে বুঝেছে তারা। ডাকাদের হাতে পড়েও চাঁদা বা মুক্তিপণ দেয়া লাগছে না, তাতেই মহা খুশি সে।

গল্প করতে করতে কয়টা সুন্দরী আর গড়ান গাছ কেটে মাচা বানিয়ে ফেললো তারা। গাছ কাটলা কেন তোমরা আবার? দস্যু ছেলেটা বললো, কয়টা গাছ কাটলে কিছু হয় না কাকু। আবার মেজাজটা খারাপ হচ্ছিলো। এর মধ্যে দেখি আমাদের মামুন এসর দাঁড়িয়েছে। হাতে গরম দুধ চা ভর্তি মগ।

(ছবির অস্ত্রগুলো সেই রাতেই RAB এর হেফাজতে চলে যায়)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top