গহীন বনে দস্যু হারুনের বিউটি সেলুন | রূপান্তরের গল্প ৮৯ | Rupantorer Golpo 89 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৮৯ : বনের ভিতর থেকে কুকু পাখি ডেকে উঠলো। অদ্ভুত এক ডাক। মনে হয় প্রতিদ্ধণি করে ডাকটি ফিরে ফিরে আসে। আসলে কুকু পাখির ডাকই এমন। জেলেরা বলে, নির্দিষ্ট সময় পর পর ডাকে এই পাখি। প্রতি পোয়া জোয়ার বা ভাটায় ডাকে কুকু পাখি। জেলেরা সেই ডাক শুনে জাল ফেলে, জাল উঠায়। নদী পথে চলতে গেলেও জোয়ার ভাটার হিসাব করতে হয়।
সুন্দরবনের জেলেরা ঘড়ি দেখে না। তাদের জীবন চলে জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে। কুকু পাখি তাদের সেই কাজের কথা মনে করিয়ে দেয় দেড় ঘন্টা পর পর। কুকু পাখির তখনকার ডাকটি ছিলো জোয়ার শুরুর ইশারা। এবিষয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা জানা নাই, তবে বনজীবীরা কেউ কেউ কুকু পাখির ডাক ধরেই কাজ সারেন।
পশুর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিলো। বনদস্যু আর জেলেদের নিয়ে গল্প করছিলাম। পরে যোগ দিলেন একজন বনকর্মী। বনজীবী, বনরক্ষী আর বনদস্যু। তিন পক্ষকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম, সুন্দরবন তখন চলতো বনদস্যুদের কথায়। এবার জেলে ভাইয়েরা ও বনরক্ষী সেই যুবক বললেন, কাজটা হলে দারুণ হবে। যে যাই বলুক আপনি এগিয়ে যান। বনদস্যুরা উঠে গেলে সুন্দরবনটা বাঁচবে, বাঁচবে মানুষ। এতোগুলো অপরাধীরা বন্দুক গুলি নিয়ে পুরো বন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্রের জন্য সেটি বিরাট থ্রেট বা ঝুঁকি। দস্যুদের বন্দুকের গুলিতে কতো বন্যপ্রাণি যে মরেছে তার হিসাব নাই। বাঘও না কী হত্যা করতো দস্যুরা। বিনা কারণে গুলি করে কুমির মারতো তারা। আমি নিজেও তার সাক্ষী। কাজেই দস্যুমুক্ত হলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে সুন্দরবনের।
কড়া পাহাড়া দিতে হবে এখন থেকে। এক মুহুর্তের জন্যও নদী থেকে চোখ সরানো যাবে না। নির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলাম। হাঁটলাম পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের পুকুর পাড়ের দিকে। জোয়ার আসলে না কী ফোনের নেটওয়ার্ক আসে! নেওয়ার্ক পেলে আরেক দফা ফোন করতে হবে। দুই দিন হলো বাসার সাথে যোগাযোগ নাই।
পুকুর পাড়ে লোকজন জড়ো হয়েছে। কী ব্যাপার? পথে দেখা পলিনের সাথে। জিজ্ঞেস করার আগেই পলিন জানালেন, পুকুর পাড়ে বারবার সপ খুলেছে হারুন। দস্যুরা একে একে বসছে। চুল দাঁড়ি কামিয়ে দিচ্ছে হারুন। তাদের ঘিরে অন্যরা হৈ হুল্লোড় করছে।
পুকুর পাড়ে যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেখানে দাঁড়ালাম। ফোনটি উঁচু করে ধরে চেষ্টট করলাম মিনিট দুই। পাশ থেকে সোহাগ বললো আরও ঘন্টা দুই পরে পাবেন। জোয়ারের পানি বাড়লে নেটওয়ার্ক আসবে। এরও কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা নাই। তবে এর প্রমাণ জঙ্গলে পেয়েছি অনেক বার।
হেঁটে এগুলাম পুকুরের দিকে। যোগ দিলাম হারুনের সুন্দরবন সেলুনের আড্ডায়। বেলায়েত সরদার ততোক্ষণে সিরিয়াল ভেঙ্গে শেইভ করেছেন। সিরিয়াল ভেঙ্গে আমাকেও বসানো হলো। শুরুতে নিমরাজি ছিলাম। তবে ওরা বললো, চেহারা আমার বিদ্ধস্ত। কাল মন্ত্রীর সামনে যাবো। পুলিশ প্রধানসহ বড় কর্তারা আসবে। শেইভ না করলে কেমন দেখাবে? তাতেও রাজি না আমি। পলিন বললেন, সকাল বেলা সরাসরি সম্প্রচার আছে। এমন চেহারা নিয়ে ক্যামেরায় দাঁড়াবেন? পাশ থেকে দস্যুনেতার মেয়ে হাত ধরে টেনে নিলো। বললো, কাকু, এবার আপনি বসে পড়েন। ভাবীরাও বায়না ধরলেন। ওদিকে আমার আগে কাউকে চেয়ারে বসাবে না হারুন।
কাঠের একটা ভাঙ্গা চেয়ার পাতানো। ময়লা একটা তোয়ালে হাতে দাঁড়ানো হারুন। আরেক হাতে ক্ষুর। দস্যুদলে হারুনের মতো এক-দুইজন থাকে এ কাজের জন্য। বসে পড়লাম চেয়ারে। গহীন বনের ভিতরে বনদস্যু হারুনের সেই বিউটি সেলুনের কথা ভুলবো না কখনও!
(ছবিটি ২০১৬ সালের ২৭ মে তোলা। পাশাখালী ফরেস্ট অফিস)