গামছা বাহিনীর গামছা কাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৯০ | Rupantorer Golpo 90 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৯০ : হারুন তো হাসতে হাসতে শেষ। আবারও বললাম, শেইভ করাতে কতো টাকা নাও তুমি? বললো, মামা আপনার কাছ থেকে টাকা নিবো না। বললাম, তা কী করে হবে? অন্যদের কাছে কতো নাও? বললো, সাধারণ রেট ২০০ টাকা। তারপর যে যা দেয়। দস্যুনেতারা নাকী বেশি টাকা দেয়? হারুন বললো, বড় লিডাররা কখনও দশ হাজার টাকাও দেয়। বললাম, গরীব মানুষের টাকা কেড়ে খাও তোমরা। সে বললো, লিডাররা প্রায় পুরোটাই নিয়ে যায়। আমরা তো জোন খাটি। জোন খাটা মানে দিন মজুরিতে কাজ করা। বলতে বলতে গায়ে গামছা জড়িয়ে দিলো। দাড়ি কামাতে গিয়ে গাল একটু কেটেও ফেললো। বললো অসুবিধা নাই মামা। ফিটকিরি দিয়ে দিবো।
একটি গামছা সঙ্গে রাখা আমার অভ্যাস। সুন্দরবনে ঘুরতে ঘুরতে অভ্যাসটি হয়। জঙ্গলে তখন ঘুরতাম সুযোগ পেলেই। ডাকাতদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ খুঁজতাম। জেলেদের সঙ্গে মিশে বোঝার চেষ্টা করতাম সুন্দনরবন জীবনের স্বরূপ। দেখতাম বনজীবীদের পরনে থাকে লুঙ্গি, ট্রাউজার বা শর্টস। গায়ে থাকে গেঞ্জি কিংবা শার্ট। পরনে যাই থাকুক সব সময় সঙ্গে থাকে গামছা। বন উপকূলের মানুষদের কাছে গামছা অতি প্রয়োজনীয় একটি বস্ত্র। সেদিনও আমার কাঁধে ছিলো গামছা। হারুনের বিউটি সেলুনে বসার সময় সেই গামছাটিই জড়িয়ে দেয়া হয়। হারুন বলছিলো, দস্যুদলের সদস্যদের বেতন মাসে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সেই টাকাও মাসে মাসে দেয় না লিডাররা। বলে যে এখন টাকা নিয়ে কী করবি? যাওয়ার সময় একসাথে দিবো।
দস্যুদলের সদস্যদের আর যাওয়ার সময় হয় না। একসাথে টাকা পাওয়া হবে কী করে? একবার উঠে গেলে সেই পাওনা টাকা নিয়ে কথা বলার সুযোগও হয় না। কেউ যদি কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে থাকে, ধরা না খায়, টাকা চাওয়ার অপরাধে তাকে ধরিয়ে দেয় লিডাররা। সোর্স এর মাধ্যমে বা সরাসরি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফোন দিয়ে তারা বলে দেয় যে ওমুক দস্যু ওখানে আছে। ধরা পড়লে জেল বা ক্রসফায়ার। তাই দেনা পাওয়ার হিসাব জঙ্গলে রেখেই পালিয়ে বেড়াতে হয় তাদের। আসলে বনদস্যুদের বেশির ভাগেরই জীবনের পরিণতি ছিলো মৃত্যু অথবা জেলখানা।
দস্যুনেতারা যারা টাকা গোছাতে পারে তারা চলে যায় ভারতে। সেখানে চোরাই পথে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে নাগরিকত্ব নেয়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া জলদস্যুদের সংখ্যা নেহায়েত কম না। কিন্তু হারুনের মতো প্রান্তিক মানুষদের ঘুরে ফিরে জঙ্গলে নামা ছাড়া উপায় থাকে না। যে কয়দিন বাঁচে জঙ্গলই ছিলো তাদের ঠিকানা।
হারুনকে বলছিলাম যে তোমাদের তাহলে ভবিষ্যৎ কী? বললো, মরণ ছাড়া তো আর কিছু দেখি না। তারপরও হাসিখুশি থাকি। আল্লাহ যেদিন মরণ রাখছে সেদিন মরবো। বাড়ি ফিরতে পারলে কথা ছিলো। বললাম কাল সকালে সারেন্ডার করবে তোমরা। তারপর যাবে জেলখানায়। জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তখন তো বাড়িতে থাকবে। কোনো একটা কাজ গুছিয়ে নিও। একটা সেলুন দিও মহেশ্বরীপুরে। হারুনের বাড়ি খুলনার কয়রার মহেশ্বরীপুরের তেঁতুলতলায়। বড় কোনো কারণ ছাড়াই দস্যুতায় নেমেছিলো সে। নেমে আর উঠতে পারেনি। কারণ ধরা পড়লেই ক্রসফায়ার!
কাজ শেষে আমার গামছাটা ধুয়ে দিলো হারুন। শুকানোর জন্য নেড়ে দিলো পুকুর পাড়ে। শেষ বিকাল। তবুও যেটুকু রোদ ছিলো তাতেই শুকিয়ে গেলো গামছাটি। পাঁচশ’ টাকা মজুরি দিয়ে উঠে পড়লাম। বেশ ফ্রেশ লাগছিলো।
ফরেস্ট অফিসের জেটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। দস্যুরা একটি একটি করে অস্ত্র পরিস্কার করে সেখানে রাখছে। গুলিগুলো আলাদা করে পাশেই রাখা। এর বাইরে সাতজনের কোমড়ে ঝোলানো পোসেস-এ। জেটিতে গামছা পাতানো। তাতে অতিরিক্ত খোলা গুলিগুলো রাখা। বন্দুকগুলোও বাঁধা গামছা দিয়ে। কাঁকড়া শিকারীরা হেঁটে হেঁটে কিছু কাঁকড়া ধরে ফিরছে। সেগুলোও গামছায় বাঁধা। ঝাঁকি জাল নিয়ে দু’জন শেষ ভাটায় মাছ ধরতে গেছিলো। তাদের পরনেও গামছা। কেজি খানেক চিংড়ি মাছ আরেকটা গামছায় বেঁধে ফিরলো তারা।
জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে প্রথম সংবাদটিতেও দেখবেন মুখে গামছা বেঁধে ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছে দস্যুনেতা। গামছায় মুখ ঢাকা দেখে কেউ কেউ বলতো সাজানো নাটক। মানে তারা আসলে দস্যু না। আমি নিজেদের লোকজন দিয়ে সাজিয়ে ইন্টারভিউ করেছি। আমিসহ আমার সহকর্মীদের সমালোচনা সইতে হতো এই গামছার কারণে। সহকর্মীদের বলেছিলাম সমালোচনার উত্তর না দিতে। বরং মজা করে নিজেদের বলতাম- গামছা বাহিনী। বলতাম, এই গামছা বাহিনী একদিন সুন্দরবকে দস্যুমুক্ত করার উপলক্ষ্য হবে। দস্যুদল মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের মধ্য দিয়ে সেটি শুরু হচ্ছে।
বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। সবাইকে গুছিয়ে নিতে বললাম। কাঠের জেটিতে রাখা অস্ত্রগুলো গণনা করে আমাদের ট্রলারে পাঠানো হলো। প্রতিটি অস্ত্রের ছবি তুললাম। এতো ছবি দিয়ে কী হবে? এক দস্যুর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, তোমরা যদি নয়ছয় করো? হাসি দিয়ে বললাম, মজা করলাম।
মোট অস্ত্র সেখানে ৪৫টি। একে একে ৪৪টি বন্দুক তোলা হলো ট্রলারে। একটি দোনলা বন্দুক রাখলাম আলাদা করে। শটগান, পয়েন্ট টুটু, ১২ বোর-এর দোনলা বন্দুক, একনলা বন্দুক আর কয়েকটি স্থানীয় অস্ত্র। সবগুলোই সচল। বললাম, লোকাল মেশিনগুলো কোত্থেকে আসলো? মাস্টার বললো গত মাসে একটা ডাকাত পার্টি ধরলাম কুঞ্চে খালের ভিতর থেকে। এগুলো তাদের অস্ত্র। আর কয়টা আছে জাহাঙ্গীর বাহিনীর। গত সপ্তাহে অভিযান চালালাম। দুইটা অস্ত্রের অর্ধেক ছাড়া পড়ছে। অস্ত্রগুলোর দাম শুনে মাথা নষ্ট আমার। শুনলাম ওখানে সুন্দরবনের দস্যুদের বাজার দর হিসাবে দুই কোটির বেশি টাকার অস্ত্র আছে। গুলির দামও কম না।
আলাদা করা বন্দুকটি তুলে দিলাম জলদস্যু শাহীনের হাতে। বললো, গুলি ছাড়া বন্দুক দিচ্ছেন ভাই? বললাম, আর গুলি নিয়ে কী করবেন? এটা হাতে দিছি শুধু ছবি তোলার জন্য। ততোক্ষণে সবার সাথে কথা বলেছিলো দস্যুনেতা। সাতজনের পর শাহীনকে দিয়ে আটজন সারেন্ডার করবে। আরিফ নামের আরও একজন আছে, সেও সারেন্ডার করতে রাজি। পরে তার হাতেও একটি বন্দুক দিয়ে বাঁকীগুলো পাঠিয়ে দিলাম বেলায়েত সরদারের ট্রলারের গোপন জায়গায়। বলে দিলাম, RAB এর কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত সবগুলো অস্ত্র আর গোলাবারুদ পাহাড়ায় রাখবে। গামছা বাহিনীর মান সম্মানের বিষয়। একটি গুলির খোসাও হারানো যাবে না। কতগুলো গুলির খোসা ছিলো সেখানে। গামছায় বেঁধে সেগুলোও পাঠালাম আমাদের ট্রলারে।
দস্যুরা একটু উসখুস করছিলো। ভাবলাম অস্ত্রগুলো নিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙ্গলো।