রূপান্তরের গল্প ৯৩ | Rupantorer Golpo 93

জাহাঙ্গীর বাহিনী আক্রমণ করতে পারে! | রূপান্তরের গল্প ৯৩

জাহাঙ্গীর বাহিনী আক্রমণ করতে পারে! | রূপান্তরের গল্প ৯৩ | Rupantorer Golpo 93 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯৩ : সন্ধ্যা নামার আগেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা বাড়ানো হলো। ফরেস্ট অফিসের দিকে এগিয়ে আনা হলো দস্যুদের ট্রলার। তার সামনে রাখা হলো আমাদের ট্রলার। মানে ট্রলারগুলো এগিয়ে আনা হলো অফিসের কাছে। পাশাখালী খালটি ছোট হলেও ট্রলার নিয়ে চলা যায়। শুধু পশুর নদীতে যেখান থেকে ঢুকেছে খালটি সেখানে চর পড়ে গেছে। শুধু পাশাখালী নয়, নিচের দিকের সবগুলো খাল-নদীর এক অবস্থা!

উল্টো পাশে ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের মুখে বিশাল চর পড়েছে। দক্ষিণে ইলশেমারি খালের মুখও ভরে গেছে পলি পড়ে। আরও দক্ষিণে গেলে চারগাঙ, মানে পশুরের সাথে শিবসা মিলেছে। এরপর হংসরাজ নদী। আরেকটু দক্ষিণে কাগা। সেখানে চেরাগখালী মোরগখালী খালের গোড়াতেও চর। সিউজখালীর অবস্থাও একই। আরও নেমে গেলে নীলকমল নদী। ড্রেজিং করে এই খালের মুখটিকে কাটা হয়েছে। কাছাকাছি অন্য খালগুলো যেমন চান্দাবুনিয়া, বইন্দে, কলাতলীর মুখেও চর। ফলে পুরো জোয়ারের সময় ছাড়া ট্রলার নিয়ে এসব খালে ঢোকা যায় না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এটি বিরাট সমস্যা। তবে দস্যুরা এই সুযোগটিই ব্যবহার করতো। ভাটায় নিশ্চিন্তে এই অঞ্চলের খালে অবস্থান নিতো দস্যুরা।

পাশাখালীতে আমরাও সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম। ওখান থেকে যেকোনো দিকে বের হওয়া যায়। শুধু বড় নদীর পাশে বলে ঝুঁকিটা বেশি। সন্ধ্যায় সেই ঝুঁকি বাড়বে সেটা আগে থেকেই মাথায় ছিলো। অস্ত্রসহ ও খালি হাতের দস্যুদের সবাই সম্ভাব্য জায়গালোতে পাহাড়ায় বসবে। সন্ধ্যা নামার আগে খেয়ে নিলো তারা।

সুন্দরবনে খাওয়ার নিয়ম ছিলো দুই বেলা। সকালে একবার। আর সন্ধ্যার আগে একবার। রাতে কোনো রান্না হয় না, রাতের খাবারের কোনো বিষয়ও ছিলো না সেখানে। সেটা জেলেদের জন্য যেমন সত্য ছিলো, তেমনি দস্যুরাও সূর্য ডোবার পর খাবার দাবারের ঝামেলায় যেতো না। সারা রাত হয় নদী-সাগর দাপিয়ে বেড়াতো। অথবা গোপন কোনো খাল থেকে আরেক গোপন খালে যেতো। প্রতি রাতেই তারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতো। সারা রাত জেগে লিডারসহ অন্যরা ঘুমাতে যেতো। ঘুম বলতে সম্পূর্ণ ঘুম না। ছোট ঘুম। বিপদ কারও জন্যই কম ছিলো না।

সন্ধ্যা নামলে সুন্দরবনে হাজারও বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে। বিপদ বাড়ে কারণ এসময় দেখা যায় না চারপাশ। সারাদিনের পরিশ্রমের পর শরীরে অবসাদ আসে। তাই এসময় শক্ত পাহাড়া না থাকলে বিপদ। প্রতিপক্ষ দস্যুদলগুলোই এসময় আক্রমণ করে বসে। শুরু থেকে আমার দুশ্চিন্তা ছিলো অভ্যন্তরীন সংঘর্ষ নিয়ে। সারেন্ডার করবে না যারা তাদের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে সেই ঝুঁকি কমেছে। কিন্তু মাস্টার বাহিনীর মাত্র ৭/৮ জন দস্যু সশস্ত্র অবস্থায় আছে সে খবর জানতে পারলে নোয়া বাহিনী বা জাহাঙ্গীর বাহিনী আক্রমণ করে বসতে পারে এই রাতেই।

শুরু হলো খোঁজ খবর। দস্যু দল দুটি কোন এলাকায় আছে তা জানতে হবে আধা ঘন্টার মধ্যে। মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা একদিকে, আমি একদিকে। যার যার সোর্স এর মাধ্যমে খোঁজ নিলাম। যতদূর জানতে পারলাম নোয়া মিয়ারা আছে তালপট্টির ওদিকে, মানে পশ্চিম সীমানায়। এই রাতের মধ্যে এদিকে আসতে পারবে না। জাহাঙ্গীর বাহিনীর খোঁজ নিলাম। ভ্রমরখালী থেকে তারা সন্ধ্যার জোয়ারে ছাড়বে। কোন দিকে যাবে, রাতে কোথায় থাকবে জানা গেলো না। ধারণা করছি, যদি খবর পেয়ে এদিকে আসেও, ওরা পজিশন নিবে চাইলেবগী খাল ও তার আগে পরের জঙ্গলে। মানে বাদায় উঠে পজিশন দিয়ে থাকবে একটি দল।

গুলি শুরু হলে চাইলেবগী খাল থেকে ট্রলার নিয়ে বের হয়ে গুলি করবে। মাস্টার বাহিনীর উপর তার অনেক ক্ষোভ। (পরে জেনেছি তারা কাছাকাছিই ছিলো। খবর পেয়েছিলো আমাদের। কিন্তু আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ভয় পেয়েছিলো এই ভেবে যে আমাদের সঙ্গে RAB আছে।)

কেউ আক্রমণ করুক না করুক, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নোয়া মিয়া ভীতু মানুষ। কিন্তু জাহাঙ্গীর নটোরিয়াস। সে পাগলামি করে বসতে পারে। মাস্টারকে বললাম চারপাশের খোঁজ খবর রাখতে। আমিও আমার সোর্সদের বলে রাখলাম। কোনো খবর পেলেই মাস্টার বাহিনীর নাম্বারটিতে খবর দিতে। সন্ধ্যার পর থেকে একজন ফোন নিয়ে বাইন গাছের উপরে বসা থাকবে। সেখানে সার্বক্ষণিক ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে। মেজর আদনানকেই জানিয়ে রাখলাম সব কথা।

কুকু পাখির ডাক শুনে বুঝলাম তিন পোয়া জোয়ার হয়েছে। মানে তিন চতুর্থাংশ জোয়ার এসে গেছে। পাশাখালী খালে পানি ঢুকছে তীব্র গতিতে। এতো স্রোত সে পানিতে মনে হলো সবকিছু ভেঙ্গে নিয়ে যাবে। খালের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবলাম একটু মাথাটা ঠান্ডা করতে হবে। আমার কাজ গোছানো শেষ। এখন এই অবস্থায় বনদস্যুদের RAB হেফাজতে দিতে পারলেই আমার কাজ শেষ। তবে সেজন্য আরও ৭/৮ ঘন্টা দেরি করতে হবে। পাশাখালী থেকে বের হয়ে ভদ্রা পর্যন্ত যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকির পথ, ঝুঁকির সময়।

মাথা গরম করে লাভ নাই। ঘুম ছাড়া শরীরটাকে টানতে কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না। আবার এক কাপ চা দিতে বললাম। তারপর বন বিভাগের জেটিতে বসলাম হুইল নিয়ে। অন্যরা হাসছিলো। ফরেস্টের ওসি সাহেব বললেন, এই জায়গায় মাছ হবে না একটাও। বলতে বলতেই মাছ দিলো টান। পাল্টা টান দিয়ে তুলে আনলাম বিশাল এক টেংড়া মাছ। আধা কেজির বেশি হবে ওজন। মাছের নাম- মোচন টেংড়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top