হিসাবের খাতা পুড়িয়ে ফেললো দস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ৯৬ | Rupantorer Golpo 96 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৯৬ : শেষ জোয়ারে থেমে যায় পানির স্রোত। সাগর কিংবা বড় নদীগুলো তখন পুকুরের মতো নিরব হয়ে যায়। ভরা জোয়ারে পানি উঠে পড়ে ডাঙ্গায়। সুন্দরবনের বেশির ভাগ অংশ ডুবে যায় পানিতে। বনজীবীরা ভরা জোয়ারকে বলেন “বন্যা জোয়ার”। এসময় পুরো সুন্দরবন থৈ থৈ করে। মনে হয় জীবন্ত চারপাশ। ভরা জোয়ারে সুন্দনবনের বন্যপ্রাণিগুলো কোথায় যায়? লক্ষাধিক হরিণ আছে সুন্দরবনে। আছে বন্যশুকর। সংখ্যায় কম হলেও আছে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের মানুষ তাদের নাম উচ্চারণ করে না। মামা বলে ডাকে। অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, এই মামারা ভরা জোয়ারে যায় কোথায়? হরিণগুলো কি পানিতেই দাঁড়িয়ে থাকে?
ভাটায় নদীর স্রোত ঘুরে যায়। সবকিছু উল্টো দিকে বইতে থাকে। জঙ্গলের পানি নামে ছোট খালে, ছোট ছোট খাল থেকে মাঝারি খালে, তারপর বড় খাল হয়ে পানি নেমে যায় বড় নদীতে, নদী গিয়ে পড়ে সাগরে। যেখানকার পানি ফিরে যায় সেখানেই। ভাটার সময় মনে হয় জঙ্গলের জঞ্জালগুলো উগড়ে বের করে আনা হচ্ছে। চাঁদের প্রভাবে পানির এই জোয়ার-ভাটা খেলা চলতে থাকে প্রতিদিন চার বার, সারা বছর, বছরের পর বছর। প্রকৃতির এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নাই। কুকু পাখি জানান দেয় সময় সময়, আর বনজীবীরা তাদের কাজগুলো সারেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
সুন্দরবন কিংবা উপকূলে চলতে গেলে জোয়ার-ভাটার হিসাব করতেই হবে। তা না হলে জেলেরা জাল পাততে পারেন না, তুলতেও পারেন না। আমাদের চলাফেরার পরিকল্পনাও চলে নদীর গতি প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে, জোয়ার-ভাটার হিসাবে। পানির উঠা-নামার এই হিসাব বুঝেছি আমি অনেক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে। তবুও মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলি। মংলা থেকে তাই সময় মতো রওনা দেয়ার তাগিদ দিচ্ছিলাম মেজর আদনানকে।
সন্ধ্যা নামার আগে কিছু কাজ করে নিতে হবে। সেজন্য সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে পলিনকে তৈরি হতে বললাম। ক্যামেরা নিয়ে মুখোমুখি হলাম দস্যুনেতা মাস্টারের। বড় নদীর পাশের গড়ান বনটির গাছগুলো ছোট ছোট। সেখানে কিছু হরগজা গাছ আছে, টাইগার ফার্ণগুলোও নতুন গজিয়েছে। তার ভিতর দিয়ে মাস্টারকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইন্টারভিউ করলাম।
মাস্টার ওরফে মোস্তফা শেখ বলছেন, ছোট বেলায় দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে একদমই আগ্রহ ছিলো না। নানা বাড়িতে থাকতাম। পরে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত আর স্কুল বা মাদ্রাসার বারান্দায়ও হাঁটা হয়নি। বললাম, স্কুলেও জাননি তাও আপনার নাম মাস্টার কেন? হাসি দিয়ে বললেন, এই নাম দস্যুতায় নামার পর দিলো। ওই ইলিয়াস যখন লিডার, তখন এই নামে ডাকতো সে। বলতো আমার আচরণ নাকী মাস্টার সাহেবদের মতো! মোস্তফা শেখ তার আসল নাম। গ্রামে মোস্ত নামে পরিচিত।
বলছিলেন, কৈশোরে আসতে আসতে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। চেয়ারম্যান মামার কর্মী হিসাবে কাজ করছিলাম। ঘের দখলের লড়াই করতাম। হাতে প্রথম অস্ত্র তুলে দেন ওই মামা।
এক নাগাড়ে বলছিলেন মাস্টার, একটা ঘের নিয়ে সংঘর্ষ হয়। অনেকে আহত হয়। প্রতিপক্ষের মামলায় আসামী হলাম। তারপর আর এলাকায় থাকার মতো অবস্থা নাই। আমি আর আমার ছোট ভাই পালিয়ে যাই। কিন্তু কতোদিন এভাবে থাকবো? পরে ওই মামাই আমাকে সুন্দরবনে পাঠিয়ে দেয়। ভাবছিলাম কিছুদিন সুন্দরবনে থেকে চলে আসবো। কিন্তু একবার বনদস্যু দলে ভিড়ে গেলে আর ফেরা যায়? সেখান থেকেই শুরু দস্যু জীবন। তারপর অনেক বার ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি। সুযোগ দেয়নি কেউ। ক্রসফায়ারের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। তার মধ্যে আপনার সঙ্গে পরিচয়। ভালো হওয়ার চেষ্টা করলাম। হলো না। ছোট ভাইটা ক্রসফায়ারে মরলো। আবার চলে আসলাম জঙ্গলে।
শেষ দফায় দস্যুতার আসার সময় আমাকে কিছু বলেননি মাস্টার। শুধু বলেছিলেন, বেঁচে থাকলে দেখা হবে। শেষ বার নোয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করে দলের নেতৃত্ব নেন মাস্টার। সদস্য থেকে হয়ে ওঠেন দস্যুনেতা। তারপর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সারেন্ডারের কথা জানান।
গড়ান বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম নদীর পাড়ে। এই পশুর নদীর স্রোতের সাথে সাথে কতো জীবন বিপন্ন হয়েছে। কতো অত্যাচার-নির্যাতনের গল্প ভেসে বেড়িয়েছে এই জলাবনে! দস্যু-জেলেদের মধ্যকার ভয়ঙ্কর সম্পর্কের একসাথে এগিয়ে চলা, বনদস্যুদের মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষ-রক্তপাত! কতো রক্ত পানিতে মিশেছে তার হিসাব করতে পারবে না কেউ। মাস্টারের মতো লোকালয় থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা দস্যুদের সংখ্যাই বেশি। তাদের ঘরে ফেরাটা জরুরি। যতোটা না তাদের জন্য, তার চেয়ে বেশি জরুরি ওই কঙ্কালসার জেলেদের জন্য। পরিশ্রমে বাঁকা হয়ে যাওয়া ওই পিঠগুলো আর কতো নির্যাতনের চাপ সইবে?
মাস্টারের চোখ ছলছল করছে। মেয়েটাকে মানুষ করার ইচ্ছা পূরণ হবে তো ভাই? বললাম, চেষ্টা তো করলাম আমরা। আপনারা এগিয়ে আসলেন। সামনের পথটুকু খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ধৈর্য ধরলে সেই দিন আসবে। মানুষ হবে আপনাদের সন্তানেরাও।
সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় হাতের অস্ত্র রেখে ক্যামেরায় দাঁড়িয়েছিলেন। জঙ্গলে অস্ত্র ছাড়া প্রথম দেখলাম তাকে। বেশ বেমানান। মানে অস্ত্র হাতেই তাকে দেখেছি এতোদিন। বললেন, এই যে অস্ত্র জমা দিচ্ছি। জীবনে আর হাতে নিবো না। কিন্তু বাড়ি ফিরতে পারবো তো? বললাম, জেলখানা হয়ে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। তারপর অন্য আসামীদের মতো করে আদালতে হাজিরা দিবেন। একটা বিষয় নিশ্চিত, আপনাদের আর কেউ তাড়াবে না। সাধারণ ক্ষমা নয়, নিরাপদে সারেন্ডার করবে, এমন কথাই ছিলো তাদের সাথে। মাস্টার বললেন, বাড়িতে থাকতে দিবে ওরা? যাদের জন্য মারামারি করলাম, মামলা খেলাম, তারাই জঙ্গলে পাঠালো, তারাই আবার বাড়ি ফিরতে দিলো না। আমি বললাম, এইবার থাকতে দিবে। এবার সরকারই আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে।
এর পর সোহাগ, ফজলু, সুলতান, সোলাইমানের সঙ্গে কথা হলো। সবার জীবনের গল্প প্রায় এক। মংলা-রামপালে চিংড়ি ঘেরের দখল পাল্টা দখল নিয়ে সারা বছরই রেষারেষি চলে। তার প্রভাব পড়ে প্রান্তিক মানুষদের উপর। মাস্টার বাহিনীর জলদস্যুরা প্রায় সকলেই সেই প্রান্তিক মানুষেরা।
সূর্যের আলো থাকতে থাকতে আরও কয়েকটি ইন্টারভিউ করলাম। এরপর চলে গেলার খালের পাড়ে। সেখানে শেষ মুহুর্তের হিসাব শেষ করেছেন সুমন। দস্যুদলের মুহুরি বা ম্যানেজার একটি খাতায় সব হিসাব লিখে রাখে। জেলেদের কাছে থেকে চাঁদা, মুক্তিপণের টাকা হলো ইনকাম। আর বাজারসহ, অস্ত্র-গুলি কেনাকাটা বড় খরচ। এছাড়া ট্রলার বানানোতে খরচ হয় এক কালীন। বেশ কিছু টাকা চাঁদা হিসাবে চলে যায় ঘাটে ঘাটে, জনে জনে। হিসাবের খাতা নেড়েচেড়ে দেখলাম। কোটি টাকার হিসাবগুলো সব সুন্দরবনের ব্যবসায়ীদের নামে লিখা। আরও কতো নাম ছিলো সে খাতায়!
সূর্য ডুবছে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যা নামার আগে সেই হিসাব নিকাষের খাতা পুড়িয়ে ফেলা হলো পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের সামনে। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর জঙ্গলের সব হিসাব।
(ছবিটি সেই বিকালের। ২৭ মে, ২০১৬, পাশাখালী)