রূপান্তরের গল্প ৯৮ | Rupantorer Golpo 98

বিপদ চলে গেলো গা ঘেঁষে! | রূপান্তরের গল্প ৯৮

বিপদ চলে গেলো গা ঘেঁষে! | রূপান্তরের গল্প ৯৮ | Rupantorer Golpo 98 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯৮ : একদম তীর ঘেঁসে যাচ্ছে ট্রলার। বেশ উচ্চ শব্দ করে। আসছে ট্রলার। সুন্দরবনের নদী খালে চলার সময় সুকানিরা অর্থাৎ চালকেরা তীর ধরে চলতে পছন্দ করে। আর চাঁদ না থাকলে অবশ্যই কোনো একটা তীর ধরতে হবে। আমাদের বেলায়েত সরদারও অন্ধকারে তীর ধরে ট্রলার চালান। এছাড়া পশুর নদী দিয়ে অনেক ধরনের নৌযান চলে। তাই মাঝ নদী দিয়ে চলাফেরা করা বেশ ঝুঁকির। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটতো তখন।

ঘন্টা বাজাতে বাজাতে একদম গায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রলার। গতি কমায়নি যখন তখনই বুঝেছি সমস্যা নাই। ততোক্ষণে ভাটার স্রোত বেশ বেড়েছে। ভাটার টান আর প্রোপেলারের ধাক্কায় বেশ ভালো গতিতে আমাদের পেরিয়ে গেলো তারা। না, কোনো বিপদ না। সাধারণ মাছ ধরার ট্রলার।

গাছাল থেকে বের হলাম। মানে বাইন গাছের আড়াল থেকে বের হলাম। সুন্দরবনের দস্যুরা গোলাগুলি করার সময় গাছাল দেয়। বড় কোনো গাছের আড়ালে অবস্থান নেয়াকে গাছাল বলে তারা। সংঘর্ষ বা বন্দুক যুদ্ধের সময় মজবুত কোনো গাছের আড়াল নেয় তারা। এটি নতুন কিছু না। যেকোনো গোলাগুলির সময় নিজেকে নিরাপদ রাখতে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। আমরা সিনেমা-নাটকেও এমন দেখেছি।

এগিয়ে গেলাম নদীর দিকে। মাস্টারদের ওখানে গিয়ে দেখি তখনও বন্দুক তাক করে দাঁড়ানো তারা। বাইন গাছের আড়ালে দাঁড়ানো। বললাম থ্রি নট থ্রি বন্দুকটা আনলোড করেন। আমার কাছে দেন। আর এখানে যারা পাহাড়ায় থাকবে তারা যেন এক মুহুর্তের জন্য না নড়ে। আর কয়েকটা ঘন্টা। ভাবলাম অন্য জায়গায় যারা পাহাড়ায় আছে তাদের একটু খোঁজ নিয়ে আসি। দু’জন অস্ত্রধারীকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দিলাম।

সকালে মাচা বানানো হলো যেখানে সেখানে গেলাম। ডিউটিতে শাহীনসহ দুই জন। গিয়ে দেখি দু’জনই গভীর ঘুমে। অস্ত্রটি পাশে রাখা। এক হাত দিয়ে ধরা। আস্তে করে সেই অস্ত্রটি নিতে গেছি। সাথে সাথে উঠে বসলো সে। সুন্দরবনের দস্যুদের ঘুম এমনই। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে তারা জেগে থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। বললাম, তোমরাও ঘুমাও না, কাউকে ঘুমাতেও দাও না। কাল জেলখানায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিও। হাঁটা দিয়ে ট্রলারের কাছে গেলাম। এক কাপ চা খাবো। মামুনকে ডাক দিলাম। সাড়া নাই।

ট্রলারে উঠে দেখি আমার সহযাত্রীরা সবাই ঘুম। বেলায়েত সরদারও ঘুম। এই ট্রলারে দস্যুদের ৪৪টি অস্ত্র রাখা আছে। গুলি আছে কয়েক হাজার। নিরাপদে রাখার জন্য সেগুলো আমাদের ট্রলারে রাখলাম। অথচ তারা ঘুমাচ্ছে? যাদের পাহাড়ার দায়িত্ব দেয়া তারা বললো সমস্যা নাই। ওসব নিতে হলে আমাদের সরায়ে নিতে হবে। কারণ অস্ত্রগুলো যেখানে রাখা তার উপরেই তারা দুজন শুয়ে ছিলো। বললাম, আর কয়েকটা ঘন্টা ভাই। কষ্ট করে এই সময়টুকু পার করো। RAB এর সাথে দেখা হওয়ার পর তোমরা যতোক্ষণ ইচ্ছা ঘুমিও।

ডেকে তুললাম তাদের। বললাম চা জ্বালাও। দুই দিন আগে নিজের বিছানা থেকে উঠেছি ভোর বেলা। তারপর আর ঘুমাইনি আমি। চা খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে টিকিয়ে রেখেছি। মামুনকে চা বানাতে বলে গেলাম দস্যুদের ট্রলারে। সজাগ তারা। পিছনের খালের দিকে তাকিয়ে বসে আছে একজন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিপদ আঁচ করার চেষ্টা। সময়টুকু পার করতে হলে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

চা আসলো। মামুন চোখ ডলতে ডলতে বললো, আপনার সাথে আমিও জেগে আছি ভাই। কিন্তু কখন ঘুম চলে আসলো বলতেও পারি না। এতো মায়া লাগলো! বেলায়েত সরদারেরও শরীর ভালো না। পেটে ভীষণ সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খাচ্ছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ওই শরীর নিয়ে আমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছেন, কখনও না করেননি। প্রান্তিক মানুষ। আমার সাথে সময় দেয়াটা তাদের জন্য আর্থিক দিক থেকে লোকসানের। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। মামুনকে জড়িয়ে ধরলাম। উঠে আবার আমাদের ট্রলারে গেলাম। অস্ত্র-গুলিগুলো চেক করলাম। বেলায়েত সরদার তখনও ঘুম। কপালে হাত রেখে দেখি জ্বর জ্বর ভাব। বললাম, সরদার ঘুমাক। তোমরা সবাই জেগে থাকো। পাহাড়ায় থাকো বাঁকীটা সময়।

কুকু পাখির ডেকে উঠলো পাশ থেকে। একই সময়ে দূর থেকেও ভেসে আসলো একই ডাক। চারপাশ থেকে কুকু পাখিগুলো মনে হলো কোনো একটা প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত। তবে সেটি মানুষের তৈরি কোনো প্রযুক্তি না। কুকু পাখির ডাক মানে এক পোয়া ভাটা হয়েছে। পাশাখালী থেকে মংলার জোয়ার ভাটার সময়ের পার্থক্য ঘন্টা খানেক হবে।

RAB এর বহর মংলায় আসেনি এখনও। রওনা হলে টাওয়ারে থাকা দস্যুদের নাম্বারে ফোন দেয়ার কথা। মেজর আদনান পশুরে নামার আগ পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিলো হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত বদলে যাবে। উচ্চ মহলের কারও আপত্তিতে ভেস্তে যেতে পারে সবকিছু। সারেন্ডারের কাজ করতে গিয়ে এই দুশ্চিন্তাটা বেশি ভুগিয়েছে আমাকে।

খালের পাশে দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ পাচ্ছিলাম। পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের ভিতরে গমগম করছে মানুষ। তিনটি ঘরের একটিতে দস্যু সরদার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আছে। একটিতে অন্য দস্যুরা ও বনকর্মীরা। ভিতরের ঘরটিতে জেলেরা বসা। রান্নাঘর তখন ব্যস্ত। আজ রাতের খাবার খাবো একসাথে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top