হরিণ মরতো প্রতিদিন! পাখি মরতো! কুমির মরতো! বাঘও মরতো! | রূপান্তরের গল্প ৯৯ | Rupantorer Golpo 99 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৯৯ : ও ভাই, আমাকে বাদ দিয়ে দিলেন? হা হা হা হা হা। গুমোট একটা পরিবেশ মুহুর্তেই ঘুরে গেলো।
ফরেস্ট অফিসের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে চিৎকার করে বলছিলেন বেলায়েত সরদার, আমাকে বাদ দিয়ে রান্না হচ্ছে? ও ভাই, আমাকে বাদ দিয়ে দিলেন? হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চলেন রান্নাঘরে যাই।
স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে রান্নাঘরে ঢুকেই খোন্তাটা হাতে নিলেন। ব্যাস! রান্নাঘর এখন বেলায়েত সরদারের দখলে। কিন্তু নতুন কী হবে? মানে বেলায়েত সরদারের কোনো আইটেম হবে? না কী সাধারণ কিছু? রাত ১১টার দিকে ট্রলার ভাসাবো আমরা। তার আগে সবাইকে খাইয়ে দিতে হবে। সরদার বললো, আমি চলে আসছি ভাই, আর কোনো টেনশন নাই। বললাম, আপনার না শরীর খারাপ? ঘুম দিয়ে নাকী এখন ভালো লাগছে তার। এছাড়া কাজের সময় চলে আসছে। শুয়ে থাকলে চলবে? সরদার পাশে থাকলে আমার মাথার ওপর থেকে চাপ নেমে যায়। একটু হাল্কা লাগে নিজেকে।
দুপুরের রান্নার মূল আইটেম ছিলো হরিণের মাংস। সেটা খাবো না বলে দস্যুদের বাবুর্চি আমার জন্য আলাদা একটা আইটেম করেছে। কী সেটা? ছোট্ট তরকারির হাঁড়ির ঢাকনা খু্লে বললাম, মুরগি? না ভাই। ওটা বক এর মাংস। কী সর্বনাশ! বক মারছেন কখন? হরিণ খাবো না বলে ওরা বিকালে পয়েন্ট টুটু বন্দুক দিয়ে বক মেরেছে। কী আশ্চর্য! শিকার ওখানে এতো সহজ! ভাবছিলাম এই যে ৫১টি বন্দুক, কয়েক হাজার গুলি সুন্দরবনের জন্য কী বিরাট হুমকি!
সুন্দরবনে তখন ছোট-মাঝারি-বড় মিলিয়ে দেড় ডজন দস্যু বাহিনী। প্রত্যেকের কাছে অস্ত্র-গুলি! এই যে তিন/চারশ’ বনদস্যু! বনের প্রাণবৈচিত্রের জন্য এরা কতো বড় হুমকি! অন্যদিকে বনরক্ষীরা ছিলো কোণঠাসা। একদিকে দস্যুদের অস্ত্রের ঝনঝনানি আর তার বিপরীতে বনরক্ষীদের নিরস্ত্র অবস্থান, সুন্দরবনকে যে কী বিপন্ন করেছিলো তা তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি।
একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ২০১৩ সালের মে মাসে গিয়েছিলাম তখনকার বড় দস্যুদল ইলিয়াস বাহিনীর কাছে। আদাচাই ফরেস্ট অফিস পেরিয়ে শিবসা নদী ধরে নেমে যাচ্ছিলাম দক্ষিণে। কথা ছিলো যাওয়ার পথে ইলিয়াস বাহিনী ডেকে নিবে আমাদের। তখন সার ভাটি। মানে ভাটা প্রায় শেষের দিকে। জেগে উঠেছে দু’পাশের চর। তাই শিবসা নদীর মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ছোট্ট ট্রলারে ছিলাম ১১ জন। হঠাৎ একজন বললো, বাম পাশের চর-এ কিছু একটা পড়ে আছে। কাছে যেতে দেখি আস্ত একটা কুমির মরে পড়ে আছে। দৈর্ঘে ১০/১২ ফুটের কম না। কতোগুলো গুইসাপ সেই মৃত কুমিরের পেট ফুটো করে মহাভোজ সারছে।
ট্রলার থেকে নামলাম। ভাটায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে গেছে। কোমড় সমান কাঁদা-পানিতে নামলাম। কুমির ভরা সেই নদীতে নেমে মৃত কুমির দেখতে যাচ্ছি! বেশ কসরৎ করে পাড়ে পৌঁছালাম। ছবি তুললাম। কাছে গিয়ে দেখি কুমিরটির মাথার কাছে ফুটো। তাহলে কি গুলিতে মারা গেলো সেটি? ছবি তুলে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যায় দেখা হলো দস্যুদের সাথে। বললাম পথে মরে পড়ে থাকা কুমিরের কথা। বললো, নিশানখালী খালের মুখে কুমিরটিকে গুলি করে হত্যা করেছে সে। তাদের হাতে এর আগেও কুমির মরেছে। মরেছে বাঘও। সেই সফর থেকে ফেরার পরেও শুনেছি ইলিয়াস বাহিনীর গুলিতে অন্তত তিনটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে!
পাশাখালীর ফরেস্ট অফিসের রান্নাঘরে সেদিন রান্না হলো হরিণের মাংস, রান্না হয়েছে বকের মাংস! বনরক্ষীরা তাকিয়ে দেখছেন সেটি। মানে সুন্দরবনের মতো একটি সংরক্ষিত বনের ভিতরে এতো কিছু ঘটছে তা কেউ জানতো না। এই বনটাকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসার বস্তুটিকে যে রক্ষা করতে হয় সেবিষয়ে আমরা সাংবাদিকরাও কাজ করি না। অন্যদের কথা নাই বা বললাম। সেই রাতে মনে মনে ভেছিলাম, দস্যুদের নিয়ে কাজ শেষ হলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র নিয়ে কাজ শুরু করবো।
অফিসের টিনের চালে আবার টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। আবার কি মেঘ করলো? বের হয়ে দেখি আকাশ অন্ধকার। একটি তারাও নাই। শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে, মানে বৃষ্টি হচ্ছে আশে পাশে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবারও বৃষ্টি নামলো। বন বিভাগের টহল ফাঁড়ীতে বসে সেই বৃষ্টি উপভোগ করবো? না কী চালের বড় বড় ফুটো দিয়ে পড়া বৃষ্টির পানি থেকে নিজেদের রক্ষা করবো? ওসি সাহেব আর বনরক্ষীরা বালতি, গামলা নিয়ে সেই পানি সামাল দিচ্ছেন। মলিন চেহারা নিয়ে নির্লিপ্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত বনজীবীরা। কখন যে এখান থেকে মুক্তি পাবে সেই অপেক্ষায় তারা। আর আমি অপেক্ষায় কখন আসবে RAB এর নৌ-বহর!